থানাতেই বসে পুলিশ, আবার সভা অলীকের

পুলিশের খাতায় তিনি ‘পলাতক’। কিন্তু ভাঙড়-কাণ্ডের চার দিন পরে, শনিবার আন্দোলনকারীদের পাশে প্রকাশ্যে দেখা গেল নকশাল নেতা অলীককে। পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনের জেরে গত মঙ্গলবার তাণ্ডব চলেছিল ভাঙড়ে। ঘটনার ময়না-তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা খুঁজে পেয়েছিলেন কিছু নকশাল নেতার ‘উস্কানি’।

Advertisement

শুভাশিস ঘটক

ভাঙড় শেষ আপডেট: ২২ জানুয়ারি ২০১৭ ০৩:২৩
Share:

স্বরূপনগর গ্রামে অলীক চক্রবর্তী। শনিবার। ছবি: সামসুল হুদা

পুলিশের খাতায় তিনি ‘পলাতক’। কিন্তু ভাঙড়-কাণ্ডের চার দিন পরে, শনিবার আন্দোলনকারীদের পাশে প্রকাশ্যে দেখা গেল নকশাল নেতা অলীককে।

Advertisement

পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনের জেরে গত মঙ্গলবার তাণ্ডব চলেছিল ভাঙড়ে। ঘটনার ময়না-তদন্তে নেমে গোয়েন্দারা খুঁজে পেয়েছিলেন কিছু নকশাল নেতার ‘উস্কানি’। পুলিশের পক্ষ থেকে নকশাল সংগঠন সিপিআই (এমএল) রেড স্টারের নেতা অলীক, তাঁর স্ত্রী শর্মিষ্ঠা-সহ কয়েক জনের নামে পুলিশের উপরে হামলা, সরকারি সম্পত্তি ভাঙচুর-সহ কয়েকটি ধারায় মোট সাতটি মামলা রুজু করা হয়। কিন্তু অভিযুক্তদের পুলিশ ধরতে পারেনি।

অথচ, শনিবার মাছিভাঙা গ্রামে দেখা গেল অলীক চক্রবর্তী এক জনের মোটরবাইকে চড়ে ঘুরছেন। ওই গ্রাম এবং পাশের খামারআইটে সভাও করেন তিনি। দু’জায়গাতেই তিনি গ্রামবাসীদের আন্দোলন চালিয়ে যেতে উৎসাহ দেন। কোথাও পুলিশের কোনও চিহ্ন ছিল না। কিন্তু সেই সময়ে ভাঙড় লাগোয়া কাশীপুর থানায় দক্ষিণ ২৪ পরগনার পুলিশ সুপার সুনীল চৌধুরী-সহ কয়েক জন পুলিশকর্তা হাজির!

Advertisement

সভায় অলীক বলেন, ‘‘আমি গ্রেফতার হয়ে যেতে পারি। আপনারা মানসিক ভাবে ভেঙে পড়বেন না। আন্দোলন চালিয়ে যাবেন। মাথা নত করা যাবে না।’’ পরে ভাঙড়-কাণ্ডে নিহত স্বরূপনগর গ্রামের বাসিন্দা আলমগির মোল্লার বাড়িতেও যান ওই নকশাল নেতা। গ্রামবাসীরা জানিয়েছেন, শুধু অলীকই নন, ইতিমধ্যে আরও কিছু নকশাল নেতা গ্রামে এসে সভা করে গিয়েছেন।

কী করছে পুলিশ?

তাণ্ডবের চার দিন পরে ভাঙড় এখনও ‘মুক্তাঞ্চল’। পদ্মপুকুর, বাদামতলা, নতুনহাট, বকডোবার মতো এলাকায় এখনও গাছের গুঁড়ি, ইটের ব্যারিকেড গড়ে রাস্তা আটকানো রয়েছে। গ্রামে এখনও পুলিশ ঢুকছে না। জেলা পুলিশের এক কর্তার দাবি, ভাঙড়ের গ্রামগুলির পরিস্থিতি এখনও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তাই ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ না-এলে অভিযুক্তদের গ্রেফতার করা যাচ্ছে না। এ দিনই অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে কাশীপুর থানার ওসি সুভাষ ঘোষ ছুটিতে চলে গিয়েছেন। দায়িত্ব পেয়েছেন রায়দিঘি থানার ওসি বিশ্বজিৎ ঘোষ।

তবে, পুলিশের নিচুতলার একাংশ মনে করছে, গোটাটাই ‘রাজনীতির খেল’। অলীকদের আগেও ধরা হয়নি, এখনও হচ্ছে না। কিন্তু কেন?

তাঁদের দাবি, গোলমালের আগে গত এক মাসে ভাঙড়-২ ব্লকের পোলেরহাট-২ পঞ্চায়েতের উড়িয়াপাড়া, শ্যামনগর, খামারআইটের মতো গ্রামগুলিতে অলীক-সহ নকশাল নেতারা যে নিয়মিত বৈঠক করেছেন, স‌ে সংক্রান্ত যাবতীয় রিপোর্ট কাশীপুর থানা এবং গোয়েন্দা দফতরের পক্ষ থেকে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হয়েছে। কিন্তু সেখান থেকে কোনও নির্দেশ আসেনি। পুলিশের ওই অংশের ধারণা— হয়তো সেই সময়ে শাসকদলের আশঙ্কা ছিল, নকশাল নেতাদের গ্রেফতার করা হলে আন্দোলনে তৃণমূল নেতা আরাবুল ইসলাম এবং তাঁর মদতদাতাদের জড়িত থাকার কথা সামনে এসে পড়বে।

কেন এমন ধারণা?

ওই পুলিশকর্মীদের যুক্তি, ভাঙড়ে আরাবুলের বিরুদ্ধে যে জমি দখলের অভিযোগ উঠছে, সে তথ্য দলনেত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে আগেই ছিল। সেই জন্য তিনি বিধানসভা ভোটে টিকিট দিয়ে জিতিয়ে এনেছিলেন ভাঙড়ের ‘ভূমিপুত্র’ রেজ্জাক মোল্লাকে। যা মানতে পারেননি আরাবুল এবং জেলা তৃণমূল নেতাদের অনেকেই। প্রকাশ্যে ওই নেতারা রেজ্জাকের বিরোধিতা করেননি।

কিন্তু আরাবুল যখন পাওয়ার গ্রিড বিরোধী আন্দোলনে নেমেছেন, তাঁর যাবতীয় কাণ্ডকারখানা জানা সত্ত্বেও মদত দিয়ে গিয়েছেন। মনে মনে ‘রেজ্জাক-বিরোধী’ ওই নেতারা চেয়েছিলেন, কোনও গোলমাল হলে রেজ্জাককেই আন্দোলন সামলাতে ‘ব্যর্থ’ হিসেবে তুলে ধরতে।

তাই প্রভাব খাটিয়ে পুলিশকে সেই সময় ব্যবস্থা নিতে দেননি শাসক দলের জেলা স্তরের নেতারা। অলীকও বিষয়টি বুঝে তলায় তলায় আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন।

জেলা পুলিশের এক কর্তা দাবি করেছেন ‘‘অলীক ও তাঁর দলবল আন্দোলনকারীদের তরফে বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে পুলিশের কাছে আসতেন। পুলিশের কাছে শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের প্রতিশ্রুতি দিলেও গ্রামে গিয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে সশস্ত্র আন্দোলনের ডাক দিয়ে সভা করতেন। সেই রিপোর্ট উপরতলায় পাঠানো হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।’’

কী বলছেন জেলা তৃণমূলের নেতারা?

দলের জেলা সভাপতি শোভন চট্টোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘পুলিশের উপর সেই সময় কোনও রাজনৈতিক চাপ ছিল বলে আমার জানা নেই। আর এখন মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী পরিস্থিতি শান্ত রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। আশপাশের এলাকার বিধায়কেরা মানুষকে বোঝাচ্ছেন। রাজনৈতিক ভাবে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা হচ্ছে। ভাঙড় এখন স্বাভাবিক।’’

কিন্তু যেখানে আরাবুল ‘খেলছেন’, সেখানে ভাঙড় কতটা স্বাভাবিক থাকবে— সেই প্রশ্ন শুধু গ্রামবাসীরাই নন, এখন তুলছেন শাসক দলেরও কেউ কেউ। এ দিনই ভাঙড়ে আরাবুলকে গ্রেফতারের দাবি উঠেছে। ‘আরাবুল-বিরোধী’ নেতা হিসেবে পরিচিত কাইজার আহমেদ পোলেরহাট-২ পঞ্চায়েতের কিছু সদস্যকে নিয়ে দলের সবর্ভারতীয় সহ-সভাপতি মুকুল রায়ের সঙ্গে তৃণমূল ভবনে দেখা করে একই দাবি তোলেন।

তৃণমূল সূত্রে জানা গিয়েছে, ওই দলের অনেকেই পাওয়ার গ্রিড এবং আরাবুল-বিরোধী ‘জমি রক্ষা কমিটি’র সদস্য। তাঁরা মুকুলবাবুর কাছে দাবি করেন, আগেও দলের শীর্ষ

নেতৃত্বকে আরাবুলের কাণ্ড-কারখানার কথা জানানো হলেও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। এখন নেওয়া হোক। মঙ্গলবারের ঘটনায় পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তাঁরা। তাঁদের মূল দাবি ছিল চারটি। গ্রিডের কাজ বন্ধ করে জমি ফেরত, আরাবুলকে গ্রেফতার, পঞ্চায়েত সমিতির পদ থেকে অপসারণ এবং আরাবুলের ছেলে হাকিবুলকে পঞ্চায়েত প্রধানের পদ থেকে সরানো। ঘণ্টাখানেক ধরে মুকুলবাবু তাঁদের দাবি শোনেন।

মুকুলবাবু কাইজারদের জানান, মুখ্যমন্ত্রী ইতিমধ্যে প্রকল্পের কাজ বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন। গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে অনাস্থা এনে আরাবুল ও তাঁর ছেলেকে সরানো হলে তাঁর আপত্তি নেই। একই সঙ্গে তিনি ভাঙড়ের বিভিন্ন রাস্তা থেকে অবরোধ তুলে নেওয়ার নির্দেশ দেন।

এত বিরোধিতা সত্ত্বেও আরাবুল কিন্তু নির্বিকার। ফের তাঁর দাবি, ‘‘ছেলে এবং আমার বিরুদ্ধে চক্রান্ত হচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন