পুলিশের সন্দেহ, খুনিরা শ্রীনুর চেনাই

খুন হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কলকাতা থেকে সে ফিরেছিল খড়্গপুরে। সদলবল গিয়ে বসেছিল নিজের আস্তানা, খড়্গপুর পুরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কার্যালয়ে। বুধবার দুপুর তিনটে নাগাদ সেখানেই পাঁচ আততায়ীর হামলা, বোমা-গুলিতে তাকে খুন করা এবং দ্রুত চম্পট দেওয়া।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ১৩ জানুয়ারি ২০১৭ ০২:৫৯
Share:

খুন হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে কলকাতা থেকে সে ফিরেছিল খড়্গপুরে। সদলবল গিয়ে বসেছিল নিজের আস্তানা, খড়্গপুর পুরসভার ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কার্যালয়ে। বুধবার দুপুর তিনটে নাগাদ সেখানেই পাঁচ আততায়ীর হামলা, বোমা-গুলিতে তাকে খুন করা এবং দ্রুত চম্পট দেওয়া। গোটা ‘অপারেশন’-এর ধরন দেখে পুলিশ মনে করছে, খুব ঘনিষ্ঠ কেউই নিকেশ করেছে রেল-শহরের ‘ডন’ শ্রীনু নায়ডুকে।

Advertisement

কেন এমন সন্দেহ?

এক পুলিশকর্তা ব্যাখ্যা দিলেন, ‘‘শ্রীনু যে ওই সময়ে ওখানেই থাকবে, সেই খবর তার কাছের লোক ছাড়া কারও পক্ষে জানা মুশকিল।’’ শ্রীনুর স্ত্রী, ১৮ নম্বর ওয়ার্ডের তৃণমূল কাউন্সিলর পূজা নায়ড়ু এ দিন জানিয়েছেন, ৬ জানুয়ারি থেকে কলকাতায় ছিল শ্রীনু। বুধবার সকালেই সে খড়্গপুরে ফেরে। পুলিশের প্রশ্ন, এই খবর আততায়ীরা জানল কী করে? তা ছাড়া দুষ্কৃতীরা যে মুখ ঢেকে এসেছিল, সেটা কি শ্রীনু তাদের চিনে ফেলবে, এই আশঙ্কায়? বুধবার শ্রীনুর সঙ্গে নিহত হয় তার ছায়াসঙ্গী ধর্মা। ধর্মার স্ত্রী রোজা এ দিন জানিয়েছেন, বুধবার দুপুরে সে বেশ উদ্বিগ্ন ছিল। বলেছিল, কেউ তাকে ফোনে গালিগালাজ করেছে।

Advertisement

এই সব তথ্য এক করেই শ্রীনু-খুনে ঘনিষ্ঠ কারও হাত দেখছে পুলিশ। বুধবার রাতেই শ্রীনুর শাশুড়ি বি মীনাকুমারী খড়্গপুর টাউন থানায় খুনের অভিযোগ দায়ের করেছেন। তবে তাতে কারও নাম নেই। বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত কাউকে গ্রেফতারও করতে পারেনি পুলিশ। তবে পাঁচ জনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।

শ্রীনু যে রেল কোয়ার্টারে থাকে, সেখান থেকে মাত্র ৫০ মিটার দূরে তৃণমূলের ওই কার্যালয়। গুলিতে জখম শ্রীনুর আরও দুই শাগরেদ এম গোবিন্দ এবং সি শ্রীনু ছাড়াও স্থানীয় বাসিন্দা বি গোবিন্দের চিকিৎসা চলছে কলকাতার এসএসকেএম হাসপাতালে। পুলিশ সূত্রের খবর, জখমদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, মুখ ঢাকা পাঁচ হামলাকারীর ধূসর একটা গাড়ি থেকে নেমে প্রথমে কার্যালয়ের বাইরে বোমা ছোড়ে। তার পর স্বয়ংক্রিয় পিস্তল থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে ভিতরে ঢোকে। শ্রীনু কার্যালয়ের ভিতরে শৌচাগারের দিকে পালাতে গেলে তার মাথা আর বুক লক্ষ করে গুলি ছোড়ে দুষ্কৃতীরা। লুটিয়ে পড়ে রক্তাক্ত শ্রীনু। গুলি খেয়ে ততক্ষণে নিস্তেজ হয়ে গিয়েছে ধর্মাও। অ্যাম্বুল্যান্সে থাকা খড়্গপুরের চিকিৎসক জানিয়েছেন, কলকাতায় আসার পথেই শ্রীনু ও ধর্মা মারা যায়।

পুলিশের একটি সূত্র জানাচ্ছে, ময়না-তদন্তের প্রাথমিক রিপোর্টে দেখা গিয়েছে, শ্রীনুর ডান কানের উপরে দু’ইঞ্চির ব্যবধানে দু’টো গুলির ক্ষত রয়েছে।

বুলেটগুলো মাথার ভিতরে রয়ে যাওয়ায় প্রচুর রক্তক্ষরণ হয়। চিকিৎসকেরা মনে করছেন, সেটাই মৃত্যুর কারণ। অভিজ্ঞ পুলিশ অফিসারদের মতে, খুব কাছ থেকে গুলি করা হয়েছিল শ্রীনুকে। তার নাভির কাছেও গভীর ক্ষত রয়েছে। সেটি বোমার স্‌প্লিন্টারের ক্ষত বলেই মনে হচ্ছে। শ্রীনুর চোখে-মুখেও স্‌প্লিন্টারের ক্ষত আছে।

ঘুরেফিরে আসছে পুরনো প্রশ্নটা— শ্রীনুকে মারল কে?

জেলা পুলিশের এক কর্তার ইঙ্গিতপূর্ণ জবাব, ‘‘তদন্তের রাস্তাটা মনে হচ্ছে মালঞ্চর দিকেই যাবে।’’ রেল-শহরের এক সময়ের ‘বাদশা’ বাসব রামবাবুর বাড়ি এই মালঞ্চয়। সিপিআই সাংসদ নারায়ণ চৌবের দুই ছেলে গৌতম ও মানস খুনে রামবাবু যখন জেল খাটছে, তখন শ্রীনুই দখল করে ‘রাম-রাজ্য’। রেল ওয়ার্কশপের চতুর্থ শ্রেণির কর্মী শ্রীনু হয়ে ওঠে খড়্গপুরের ‘নয়া ডন’। ২০১০ সালে সুপ্রিম কোর্ট থেকে জামিন পেয়ে রামবাবু খড়্গপুরে ফিরলেও হারানো রাজ্যপাট আর ফিরে পায়নি। ২০১২ সালে রামবাবুর উপরে হামলাতেও নাম জড়িয়েছিল শ্রীনুর। তবে কি পুরনো আক্রোশে রামবাবুই এই কাণ্ড ঘটাল? পুলিশকর্তা এ বার নিরুত্তর।

তৃণমূল নেতৃত্বের তরফে আবার ইঙ্গিত রেল-শহরের বিধায়ক তথা বিজেপির রাজ্য সভাপতি দিলীপ ঘোষের দিকে। যদিও জেলার পুলিশ সুপার ভারতী ঘোষ, খড়্গপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এবং এসডিপিও-র অপসারণ দাবি করে দিলীপবাবু এ দিন বলেন, ‘‘হিম্মত থাকলে সিবিআই তদন্ত করান। আর খড়্গপুরের পুরপ্রধান প্রদীপ সরকার জেলে গিয়ে শ্রীনুর সঙ্গে কী চুক্তি করেছিলেন, সেটাও প্রকাশ করুন। সত্য প্রকাশ্যে এলে তাপস পাল, সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো তৃণমূলের অনেককেই জেলের ভাত খেতে হবে।’’ দিলীপবাবুর অভিযোগ, পুরসভার দখল নিতে শ্রীনুকে ব্যবহার করেছিল তৃণমূল। সেই অভিযোগ উড়িয়ে দিয়েছেন পুরপ্রধান।

রাজনৈতিক তরজা চললেও প্রাথমিক ভাবে পুলিশ মনে করছে, এলাকা দখলের লড়াইয়ের জেরেই খুন হল শ্রীনু। রেলের ছাঁট লোহার কোটি কোটি টাকার কারবারের দখলদারি ঘিরে বারবার রক্তাক্ত হয়েছে

খড়্গপুর। তাই শ্রীনুরই হাত ধরে অন্ধকার পথে হাঁটতে শেখা কেউ সাম্রাজ্যের দখল নিতে তাকে সরিয়ে দিল কি না— এমন সম্ভাবনাও উড়িয়ে দিচ্ছে না পুলিশ।

তদন্তে উঠে আসছে প্রসাদ রাও নামে শ্রীনুর এক পুরনো সঙ্গীর কথা। ট্রাভেলসের ব্যবসা সামলানো এই যুবকের সঙ্গে শ্রীনুর বিরোধ শুরু হয় ২০১৫ সাল থেকে। গত বিধানসভা ভোটের সময় থেকে বিজেপির সঙ্গে যোগাযোগ রাখছিল এই প্রসাদ।

আর শ্রীনু ক্রমশ ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়ে তৃণমূল শিবিরের। আসছে পুরনো আক্রোশের তত্ত্বও। ২০১৪ সালের মে মাসে দুই পুরনো সঙ্গীকে মারধরের ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিল শ্রীনু।

সেই ঘটনার কথা উল্লেখ করে পুলিশকর্তারা মনে করিয়ে দিচ্ছেন, মাফিয়া জগতে ‘বদলা’র খেলা চলেই। রাজা আসে, রাজা যায়— এটাই কালো দুনিয়ার নিয়ম। খড়্গপুরও তার ব্যতিক্রম নয়।

শ্রীনুর সিংহাসনে এ বার তা হলে কে? ফের কি আশঙ্কা রয়েছে কোনও গ্যাং-ওয়ারের? উত্তর হাতড়াচ্ছে রেল-শহর।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন