গণনার পরে পুলিশ আক্রান্ত দুই এলাকায়

ভোট পরবর্তী হিংসা আর কেবল রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে আটকে রইল না। আক্রান্ত এ বার পুলিশও। থানা ভেঙে পুলিশ পেটানোর সেই খবর শোনার পরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বও মেনে নিচ্ছেন, ঘটনাগুলি লজ্জাজনক। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী আইনানুগ ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দিয়েছেন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২১ মে ২০১৬ ০৩:৫২
Share:

নিহত তৃণমূল কর্মীর মা সুভদ্রা পরামানিক। ছবি: সুজিত মাহাতো।

ভোট পরবর্তী হিংসা আর কেবল রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে আটকে রইল না। আক্রান্ত এ বার পুলিশও। থানা ভেঙে পুলিশ পেটানোর সেই খবর শোনার পরে তৃণমূলের শীর্ষ নেতৃত্বও মেনে নিচ্ছেন, ঘটনাগুলি লজ্জাজনক। ক্ষুব্ধ মুখ্যমন্ত্রী আইনানুগ ব্যবস্থা নিতেও নির্দেশ দিয়েছেন।

Advertisement

গোলমালের সূত্রপাত গণনার দিন, বৃহস্পতিবারেই। সময়, কখনও দুপুর, কখনও গভীর রাত। স্থান, কখনও দক্ষিণ ২৪ পরগনার পঞ্চসায়র এলাকার শহিদ স্মৃতি কলোনি, কখনও উত্তর ২৪ পরগনার নিউ ব্যারাকপুর এলাকা। কিন্তু দুই ঘটনাতেই আক্রান্ত পুলিশ।

পঞ্চসায়র এলাকায় গোলমাল শুরু হয় দুপুরবেলা। এলাকাটি যাদবপুর বিধানসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত। পুলিশ সূত্রে খবর, গণনা চলাকালীনই ওই এলাকায় সুজন চক্রবর্তীর সমর্থনে মিছিল বেরোয়। আবির খেলাও শুরু করেন সিপিএম কর্মী-সমর্থকেরা। তখনই পাল্টা সবুজ আবির নিয়ে হইচই শুরু করেন স্থানীয় কিছু তৃণমূল কর্মী-সমর্থক। শুরু হয় গালিগালাজ, হাতাহাতি। সেই সময় পুলিশি তত্পরতায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসে। অভিযোগ, রাতে শহিদ স্মৃতি কলোনিতে সিপিএম পার্টি অফিসে চড়াও হয় বেশ কিছু দুষ্কৃতী। তারা ওই এলাকা জুড়েও তাণ্ডব চালায় বলে অভিযোগ। গোলমাল থামাতে গেলে ইটের ঘায়ে জখম হন দুই কনস্টেবল। মাথা ফাটে এক জনের, হাঁটুতে আঘাত পান অন্য জন। দুষ্কৃতীদের ইটের ঘায়ে ঠোঁট ফাটে সাব-ইনস্পেক্টর প্রকাশ সমাদ্দারের। হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিত্সকেরা জানান, ঠোঁটের উপরের একটি শিরা ছিঁড়ে যাওয়ায় তাঁর অস্ত্রোপচার প্রয়োজন। পুলিশ নিজে থেকেই অজ্ঞাতপরিচয় আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে এফআইআর করেছে।

Advertisement

বৃহস্পতিবারই রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ নিউ ব্যারাকপুরে মানুন্দা চণ্ডীতলার বাসিন্দা তথা সিপিএমের লোকাল কমিটির সদস্য মানিক দত্তগুপ্তের বাড়িতে হামলা চালায় দুষ্কৃতীরা। মানিকবাবুর অভিযোগ, ‘‘বাড়িতে ইটবৃষ্টি তো বটেই, দরজা ভেঙে ভিতরে ঢোকারও চেষ্টা করে ওরা।’’ খবর পেয়ে কিছু ক্ষণের মধ্যেই চলে আসে নিউ ব্যারাকপুর থানার পুলিশ। ঘটনাস্থলে থাকা এক এএসআই বলেন, ‘‘যারা গুন্ডামি করছিল, আমরা তাদের বোঝানোর চেষ্টা করেছিলাম। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সামলাতে লাঠি চালাতে বাধ্য হই।’’

অবস্থা সামাল দেওয়া গিয়েছে মনে করে পুলিশ বাহিনী থানায় ফিরে যায়। কিন্তু রাত ২টো নাগাদ একশোরও বেশি তৃণমূল কর্মী থানা ঘিরে ফেলে বলে অভিযোগ। পুলিশ সূত্রের বক্তব্য, এলোপাথাড়ি ইটে থানার বাইরের আলো ভেঙে যায়। তখনই থানায় ঢুকছিলেন ওসি রাজু মুখোপাধ্যায়-সহ চার পুলিশ। তাঁরা জখম হন। তার পরে হামলাকারীরা ডিউটি অফিসারের ঘরে ঢুকে ভাঙচুর করে বলেও অভিযোগ। টেলিফোন, কম্পিউটার ভেঙে প্রয়োজনীয় নথি ছিঁড়ে ফেলে।

ঘণ্টাখানেক তাণ্ডবের পরে সেই বাহিনী ফিরে যায়। পুলিশের অভিযোগ, ঘটনায় নেতৃত্ব দেন নিউ ব্যারাকপুর শহর তৃণমূলের সভাপতি সুখেন মজুমদার ও স্থানীয় ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মনোজ সরকার। ঘটনার কথা জানতে পেরে প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ তৃণমূল নেতৃত্ব দ্রুত ব্যবস্থা নিতে বলেন পুলিশকে। ভোররাতে সুখেনবাবু-সহ ১১ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তিন জনের জেল হাজত হয়েছে শুক্রবার। তৃণমূলের জেলা সভাপতি জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘হিংসা আমাদের নীতি নয়। কোনও রকম হিংসাত্মক ঘটনা আমরা বরদাস্ত করব না।’’

এর পাশাপাশি, বিরোধী নেতা-কর্মীদের উপরে হামলার অভিযোগও লাগাতার উঠেছে বৃহস্পতিবার থেকে। যা জারি রয়েছে শুক্রবারেও। এ দিন রাত ন’টা নাগাদ বেলেঘাটার

রামমোহন মল্লিক গার্ডেনে সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য মৃণাল রায়চৌধুরীর বাড়িতে তৃণমূল আশ্রিত দুষ্কৃতীরা ভাঙচুর করে বলে অভিযোগ। একটি ঘরে আগুনও লাগানো হয়। বিধানসভা ভোটে স্থানীয় সিপিএম প্রার্থী রাজীব বিশ্বাস বলেন, ‘‘মৃণালবাবু আমার নির্বাচনী এজেন্ট ছিলেন। সেই কারণেই পরিকল্পনা করে এই হামলা চালানো হয়।’’ এলাকার তৃণমূল নেতা স্বপন সমাদ্দারের দাবি, ‘‘দুই দলের কর্মীদের মধ্যে বচসা থেকেই গোলমাল। পুলিশকে খবর দিয়েছি। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে।’’ তবে এলাকার আরও কয়েক জন সিপিএম কর্মীর বাড়িতেও হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ।

কোথাও এ ভাবেই বাড়িতে চড়াও হওয়া বা ভয় দেখানো, কোথাও পার্টি অফিস ভাঙচুর। বৃহস্পতিবার দুপুরে পূর্ব কলকাতায় আক্রান্ত হন এক সিপিএম কর্মী। অভিযোগ, সবুজ আবির মাখা একটি ছেলে এসে তাঁকে ডেকে নিয়ে যায়। তার পরে কয়েক জন তাঁকে মারধর করে। তবে ওই সিপিএম কর্মী জানিয়েছেন, বাড়িতে বৃদ্ধা মা, স্ত্রী, দুই মেয়ে আছেন। তাঁদের নিরাপত্তার কথা ভেবেই তিনি এ নিয়ে কিছু বলতে চান না।

বৃহস্পতিবার দুপুরে এন্টালিতে গোবরা গোরস্থানের কাছে পার্টি অফিসে তৃণমূল সমর্থকেরা ভাঙচুর চালায় বলে অভিযোগ সিপিএম প্রার্থী দেবেশ দাসের। পানিহাটির কংগ্রেস প্রার্থী সন্ময় বন্দ্যোপাধ্যায় অভিযোগ করেন, বৃহস্পতিবার তাঁর বাড়িতে হামলা চালায় জনা ৩০ দুষ্কৃতী। বাড়ির পাঁচিলে বোমাও ছোড়া হয়। ব্যারাকপুর শহর কংগ্রেসের অফিসে, সল্টলেক এলাকায় সিপিএমের অফিস ও কর্মীদের বাড়িতে, কসবার বি বি চ্যাটার্জি রোডে সিপিএম কর্মীর বাড়িতে তৃণমূলের একের পর এক হামলার অভিযোগ উঠেছে। এমনকী হালিশহরের প্রতিবাদী ভোটার সৃজনী বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়িতেও ভাঙচুর হয়েছে বলে খবর। সব ক্ষেত্রেই অভিযোগ অস্বীকার করেছে তৃণমূল।

হামলার অভিযোগ এসেছে জেলা থেকেও। কোচবিহারে সাবেক ছিটমহল এলাকায় দু’টি বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। এক জনকে মারধরের পাশাপাশি এলাকার বাসিন্দাদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা চাওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। মেদিনীপুর, কেশপুর, ঝাড়গ্রামে সিপিএমের একাধিক অফিসে ভাঙচুরের অভিযোগ উঠেছে। পূর্ব মেদিনীপুরে আবার পাল্টা অভিযোগ শোনা গিয়েছে তৃণমূলের মুখে। হলদিয়ায় এক আইএনটিটিইউসি কর্মী অভিযোগ করেন, দলীয় দফতরে ঢুকে ভাঙচুর চালিয়েছে দুষ্কৃতীরা। আবার সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে তাদের দফতরে আগুন লাগানোর অভিযোগও তুলেছে তৃণমূল। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে উত্তপ্ত আসানসোলের শ্রীপল্লি, জামুড়িয়া, বালানপুর, কেন্দা, পুরুলিয়ার বিভিন্ন এলাকা। বৃহস্পতিবার বিকেলে জাঙ্গিপাড়া বিধানসভার ফুরফুরায় তৃণমূলের একটি কার্যালয়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ ওঠে সিপিএমের বিরুদ্ধে। তার পাল্টা রশিদপুরে সিপিএম এজেন্টকে হুমকি দেওয়া হয়ে বলে অভিযোগ। ব্যান্ডেলের মেরিপার্কে সিপিএমের ব্যান্ডেল শাখা সম্পাদক শিবাজি মিশ্রের বাড়িতে তৃণমূলের বাইক বাহিনীর চড়াও হওয়ার অভিযোগ উঠেছে। বালির মোড়ে সিপিএমের একটি কার্যালয়ে দরজা-জানলা ভাঙে দুষ্কৃতীরা।

উত্তর কলকাতায় কাটমারবাগান লেনে আবার তৃণমূলেরই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে উত্তেজনা ছড়ায়। ভোটের পরে এখানেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে স্থানীয় এক নেতার বাড়িতে ভাঙচুর হয়েছিল। খবর পেয়ে পুলিশের বিশালবাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছয়। পুলিশের একাংশের অবশ্য বক্তব্য, কলকাতার কাছাকাছি দু-তিনটি ঘটনা ছাড়া বাকিগুলি তেমন বড় কিছু নয়। তা-ও চেষ্টা করা হচ্ছে, এমন যেন না ঘটে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন