শঙ্খের ডিলিট, মমতাকে আমন্ত্রণ ঘিরে বিতর্ক

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গোলমাল সম্পর্কে নিজের বক্তব্য জানাতে গিয়ে ফের নতুন বিতর্ক এবং প্রশ্ন তুলে দিলেন উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া। মঙ্গলবারের সাংবাদিক বৈঠকে যে দু’টি প্রসঙ্গ নতুন করে বিতর্ক তৈরি করেছে তার একটি মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানানো এবং অন্যটি শঙ্খ ঘোষকে ডিলিট না-দেওয়া।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদাতা

কলকাতা শেষ আপডেট: ২৬ অগস্ট ২০১৫ ০৩:৩৭
Share:

সাংবাদিক বৈঠকে প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া। মঙ্গলবার।— নিজস্ব চিত্র।

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক গোলমাল সম্পর্কে নিজের বক্তব্য জানাতে গিয়ে ফের নতুন বিতর্ক এবং প্রশ্ন তুলে দিলেন উপাচার্য অনুরাধা লোহিয়া। মঙ্গলবারের সাংবাদিক বৈঠকে যে দু’টি প্রসঙ্গ নতুন করে বিতর্ক তৈরি করেছে তার একটি মুখ্যমন্ত্রীকে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমন্ত্রণ জানানো এবং অন্যটি শঙ্খ ঘোষকে ডিলিট না-দেওয়া।

Advertisement

মুখ্যমন্ত্রীর প্রেসিডেন্সির সফরের দিন পুলিশি হেনস্থার অভিযোগ তুলে পড়ুয়াদের আন্দোলন এ দিনও চলেছে। নিজের দফতরে আসার মুখে বিক্ষোভের মুখে পড়েন উপাচার্য। তিনি সস্নেহে পড়ুয়াদের সরিয়ে দিয়ে ভিতরে ঢোকেন। আন্দোলন সম্পর্কে নতুন করে কোনও বিরূপ মন্তব্য না-করে উপাচার্য বলেন, ‘‘ওরা অনেক ছোট। তাই রাগের মাথায় ভুল করে ফেলেছিল। তবে ওরা যে ভুল বুঝে দুঃখ প্রকাশ করেছে, এর জন্য আমি ওদের প্রতি গর্বিত। ওরা প্রেসিডেন্সির মর্যাদা বজায় রেখেছে। তবে পদত্যাগ কখনওই নয়।’’ পড়ুয়ারা অবশ্য জানান, তাঁরা এখনও উপাচার্যের পদত্যাগের দাবিতে অনড়। এবং সেই দাবি সামনে রেখে তাঁদের বিক্ষোভ চলবে। আন্দোলনকারী পড়ুয়াদের সঙ্গে আলোচনা করতে এ দিনই একটি কমিটি গঠনের কথা ঘোষণা করেন উপাচার্য। তিনি জানান, সাত দিনের মধ্যে ওই কমিটি রিপোর্ট দেবে। সেই রিপোর্টের ভিত্তিতে পরবর্তী পদক্ষেপ করা হবে।

মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানোর বিষয়ে এ দিন উপাচার্য বলেন, ‘‘২২ অগস্ট সমাবর্তনের অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতি আমন্ত্রিত ছিলেন। সে কারণেই মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়। আমি মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানাতে গিয়েছিলাম।’’ যদিও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য আনন্দদেব মুখোপাধ্যায়ের দাবি, ‘‘রাষ্ট্রপতিকে আমন্ত্রণ করলেই যে মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ করতে হবে এটা কোনও প্রোটোকলে নেই।’’

Advertisement

২২ তারিখ ব্যস্ত থাকবেন বলে সমাবর্তনে যেতে পারবেন না, উপাচার্যকে জানিয়ে দেন মুখ্যমন্ত্রী। উপাচার্য এ দিন বলেন, ‘‘পরে তিনি (মুখ্যমন্ত্রী) নিজেই ২১ অগস্ট আসতে চান। তিনি আমাকে বলেন, ‘তুমি ভাল কাজ করছ। আমি যাব।’ ওই দিন ওঁর থেকে অনুদান নেওয়ার ছিল। তাই ডেকেছি।’’ কার্যত মুখ্যমন্ত্রীর জন্যই সমাবর্তনের আগের দিন বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। উপাচার্যের পাল্টা প্রশ্ন, ‘‘মুখ্যমন্ত্রী আসতে চাইলে আমি কি তাঁকে বারণ করব?’’

প্রেসিডেন্সির অন্দরেই প্রশ্ন উঠেছে, উপাচার্যের কাজের মূল্যায়ন কি মুখ্যমন্ত্রীর এক্তিয়ারের মধ্যে পড়ে? শুধু তা-ই নয়, মুখ্যমন্ত্রীর মূল্যায়ন উপাচার্যের কাছে এত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলই বা কেন? এ বিষয়ে শিক্ষামহল ও প্রেসিডেন্সির অন্দরের আরও বক্তব্য, রাজ্যের প্রথম সারির এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে মুখ্যমন্ত্রীকে আমন্ত্রণ জানানো হয়তো বা মেনে নেওয়া যায়, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রীর জন্য সে দিন যে ভাবে তোরণ তৈরি করা হয়েছিল, তা প্রেসিডেন্সির মর্যাদার সঙ্গে একেবারেই খাপ খায় না। এর পাশাপাশি মুখ্যমন্ত্রীর অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ প্রথম বর্ষের পড়ুয়াদের প্রতি যে বিজ্ঞপ্তি জারি করেছিলেন, তা-ও প্রেসিডেন্সির মর্যাদার পক্ষে হানিকর বলেই মনে করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউ কেউ।

শঙ্খ ঘোষকে ডিলিট না-দেওয়া নিয়ে উপাচার্যের যুক্তি, ‘‘গভর্নিং বডি-র প্রস্তাব অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং শঙ্খ ঘোষের নাম ছিল ডিলিট প্রাপকের তালিকায়। সমাবর্তনের ওই স্বল্প পরিসরের অনুষ্ঠান কী ভাবে পুরোটা সাজানো হবে এ নিয়ে ধন্দে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তাই ঠিক করা হয়, শুধু হাসিনাকেই ডি-লিট দেওয়া হবে। মাস দেড়েক আগে চিঠি পাঠানো হয়। সমাবর্তনের তিন-চার দিন আগে বিদেশ মন্ত্রক রাজ্যের স্বরাষ্ট্র দফতরকে জানায়, হাসিনা আসতে পারবেন না। তখন শঙ্খবাবুকে আমন্ত্রণ জানানোর মতো সময় ছিল না। তাই ঠিক করা হয় পরে শঙ্খবাবুকে অনুষ্ঠান করে সম্বর্ধিত করব।’’

তবে প্রেসিডেন্সির অনেকেই উপাচার্যের এই দাবি মানতে চাননি। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্দরের খবর, গোড়ায় ঠিক হয়েছিল, সমাবর্তনে এক জনকে সাম্মানিক ডিলিট এবং এক জনকে সাম্মানিক ডিএসসি দেওয়া হবে। গর্ভনিং বডিতে যে নাম আলোচিত হয় সেখানে ডিএসসি-র জন্য জয়ন্তবিষ্ণু নার্লিকার এবং ডিলিট-এর জন্য শঙ্খ ঘোষের নাম ওঠে। নামগুলি নিয়ে সেখানে কোনও আপত্তিও ওঠেনি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম আসে জনসেবামূলক কাজে তাঁর অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ। বিজ্ঞান বা কলাক্ষেত্রের সঙ্গে এর কোনও যোগাযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন ওঠে শেখ হাসিনার আসা না-আসার সঙ্গে কলা বিভাগে শঙ্খবাবুকে ডিলিট দেওয়া বা না-দেওয়ার সম্পর্ক কোথায়?

এ বিষয়ে অবশ্য উপাচার্য কিছুই বলতে চাননি। তবে প্রেসিডেন্সির একটি সূত্র বলছে, সমাবর্তনে উপস্থিত থাকার জন্য রাষ্ট্রপতি এক ঘণ্টার সামান্য কিছু বেশি সময় দিয়েছিলেন। এই সময়ের মধ্যে অন্যান্য অনুষ্ঠান সেরে দু’জনকে সাম্মানিক ডিলিট ও এক জনকে সাম্মানিক ডিএসসি দেওয়া যাবে কি না, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছিল। তাই শঙ্খবাবুকে পরে সম্মান দেওয়ার কথা ভাবা হয়। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির সফর যখন বাতিল হয়, তখন আর অনুষ্ঠানসূচি বদলের সময় ছিল না।

শঙ্খবাবু প্রসঙ্গে উপাচার্য যে যুক্তি দিয়েছেন, তা মানতে নারাজ শিক্ষা জগতের সঙ্গে যুক্ত আরও অনেকেই। শিক্ষাবিদ পবিত্র সরকার যেমন বলেন, ‘‘আমি একেবারেই বুদ্ধিমান নই। তাই উপাচার্যের খাড়া করা এই যুক্তি আমার বোধগম্য হচ্ছে না।’’ আনন্দদেববাবু বলেন, ‘‘এই যুক্তি হাস্যকর। শেখ হাসিনা না এলেও শঙ্খবাবুর ডিলিট পাওয়া নিয়ে কোনও সমস্যা হওয়ার কথা নয়।’’ তবে প্রেসিডেন্সির প্রাক্তন অধ্যক্ষ অমল মুখোপাধ্যায় সরাসরি রাজনৈতিক কারণই উল্লেখ করেছেন। তাঁর অভিযোগ, ‘‘শঙ্খবাবু সরকারের বিরুদ্ধে কথা বলেন। সে কারণেই কোনও অছিলায় তাঁকে ডিলিট দেওয়া হয়নি। এটা প্রেসিডেন্সির উৎকর্ষের সঙ্গে বেমানান। সমাবর্তন হল, অথচ এক জনকেও ডিলিট দেওয়া হল না। এটা ঠিক নয়।’’

এ দিনই হরিনাভির একটি স্কুলের দেড়শো বছর পূর্তি অনুষ্ঠানে শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় বলেন, ‘‘বাড়িতেও যেমন অলিখিত অনুশাসন রয়েছে, বড়দের শ্রদ্ধা করতে হয়। শিক্ষাঙ্গনেও এ রকম অলিখিত অনুশাসন রয়েছে। তা মনে রাখা উচিত।’’ এ বিষয়ে সাংবাদিকেরা তাঁকে প্রশ্ন করেন তিনি কি শুধু প্রেসিডেন্সি নিয়ে এ কথা বলছেন? উত্তরে মন্ত্রী বলেন, ‘‘না, আমি সমস্ত শিক্ষাঙ্গন নিয়েই কথা বলেছি। ভাল ফল মানেই ভাল মানুষ নয়। সমাজের কাজ করতে হয়।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন