কখন ঘাড়ে এসে পড়ে ‘দেশদ্রোহী’ তকমার থাবা, ত্রস্ত সোশ্যাল মিডিয়া

খাতায়-কলমে মন্তব্য বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এ দেশে সাংবিধানিক অধিকার।

Advertisement

ঋজু বসু

কলকাতা শেষ আপডেট: ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ ০৩:৫৯
Share:

পুলওয়ামা-কাণ্ডের পরে অনেকের পোস্ট নিয়েই কার্যত ‘দেশদ্রোহ’-এর অভিযোগ উঠেছে। ছবি: পিটিআই।

পাহাড় বা সমুদ্রে বেড়াতে গিয়ে ছবি দিন। রেস্তরাঁর খাবারের ছবিও চলবে। বিবাহবার্ষিকী, সন্তানের জন্মদিন বা তমুক পুজো উপলক্ষে ভাল ভাল কথা লিখতে বাধা নেই। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়ায় এই নিরাপদ পরিসরটুকুর বাইরে পা বাড়ালেই বিপদের আশঙ্কা ইদানীং নানা মহলে দানা বাঁধছে।

Advertisement

খাতায়-কলমে মন্তব্য বা মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এ দেশে সাংবিধানিক অধিকার। তবে সরকারি-বেসরকারি সব ক্ষেত্রেই সাধারণত, কোনও কর্মচারীর মত যেন সরকার বা সংশ্লিষ্ট সংস্থার মত বলে চালানো না-হয়, সেটা খেয়াল রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। বাস্তবে কিছু ক্ষেত্রে কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ব্যক্তির নিজস্ব মত নিয়েও কর্পোরেট সংস্থাগুলি স্পর্শকাতর।

বিষয়টি ব্যাখ্যা করছেন তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থাগুলির সংগঠন ন্যাসকমের পূর্বাঞ্চলীয় অধিকর্তা নিরুপম চৌধুরী। তাঁর মতে, ‘‘গত ৭-৮ বছরে সোশ্যাল মিডিয়ার রমরমার পটভূমিতে পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টেছে। ব্যক্তি বা কোনও কর্মীর সোশ্যাল মিডিয়া প্রোফাইলও ক্রমশ খোলা সিভি বা জীবনপঞ্জির চেহারা নিয়েছে। তাই ব্যক্তিগত বিষয়টাও ঠিক ব্যক্তিগত পরিসরে আটকে নেই।’’ বেশির ভাগ কর্পোরেট পেশাদারের অভিজ্ঞতা, বাস্তবে অধিকাংশ কর্পোরেট সংস্থাই ভাবমূর্তি সচেতন। কর্মীর ব্যক্তিগত মতের জেরে তাদের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হোক, এটা কোনও সংস্থাই চায় না। নিরুপমবাবুর কথায়, ‘‘ফেসবুক, টুইটার, লিঙ্কডইন প্রভৃতি সোশ্যাল মিডিয়ায় কোনটা ব্যক্তিগত আর কোনটা পেশাগত— ফারাকটা কার্যত নামমাত্র। অতএব স্পর্শকাতর বা বিতর্কিত বিষয়ে কিছু লিখতে খুব সাবধান থাকা উচিত।’’

Advertisement

কর্পোরেট ক্ষেত্রের বাইরেও সোশ্যাল মিডিয়ার ধাক্কা কম জোরালো নয়! একটি পরিচিত ইংরেজি মাধ্যম সিবিএসই বোর্ডের স্কুলশিক্ষকের ‘চাকরি যাওয়া’ বা দুর্গাপুরের বিমাকর্মীর বিরুদ্ধে ‘বিভাগীয় ব্যবস্থা’ নিয়ে এখন বিতর্ক তুঙ্গে। পুলওয়ামা-কাণ্ডের পরে তাঁদের পোস্ট নিয়ে কার্যত ‘দেশদ্রোহ’-এর অভিযোগ উঠেছে। আপাত ভাবে রাজ্য বা কেন্দ্রের সরকারি আইনে সোশ্যাল মিডিয়াকে সে-ভাবে ধর্তব্যের মধ্যে আনা হয় না। কিন্তু সরকারি আইনেও সংবাদমাধ্যমে মত প্রকাশ করতে গেলে আগাম অনুমতি নেওয়া দস্তুর। সেই অনুমতি ‘রিনিউ’ করতে হয়। তবে সরকারি কর্মচারীদের কয়েকটি সংগঠনের মতে, প্রতিশোধের মানসিকতা থাকলে সোশ্যাল মিডিয়ার মন্তব্য অপছন্দ হলে শাসক দলও ব্যবস্থা নিতে পারে।

যেমন এ রাজ্যে ২০১৭ সালেই স্কুলশিক্ষকদের আচরণবিধিতে বলা হয়েছিল, দেশ, রাজ্য বা সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কিছু বলা যাবে না। কোনও কোনও মহলে আশঙ্কা, সোশ্যাল মিডিয়াকে এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় টেনে আনা হলেও হতে পারে। তবে আইনজীবী জয়ন্তনারায়ণ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, ‘‘সোশ্যাল মিডিয়ায় মতপ্রকাশের জেরে চাকরি থেকে বরখাস্ত করার মতো আইন এ দেশে নেই। বড়জোর কারও বক্তব্যে আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বা সাম্প্রদায়িক গোলমালের আশঙ্কায় পুলিশি পদক্ষেপ হতে পারে।’’

তবু সোশ্যাল মিডিয়ার পরিসরকে আত্মপ্রচারে কাজে লাগাতেও তৎপর সরকারি-বেসরকারি সব কর্তৃপক্ষই। তাই ছাপোষা গেরস্তের সময়টা ভাল যাচ্ছে, এমনটা বলা যায় না। বাক্‌-স্বাধীনতার রমরমাতেও সোশ্যাল মিডিয়ায় কখন ‘ঘাড়ে এসে পড়ে থাবা’— ভয়টা থেকেই যাচ্ছে।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন