‘আর সিপিএম করবি? কান ধরে শুরু কর ওঠবোস’

বোমা-বন্দুকে ডরানো? নেই। ঘরবাড়ি জ্বালানো, গ্রামছাড়া করা, ‘চড়াম, চড়াম’ বাদ্যিও একেবারে না-পসন্দ। ‘একুশে আইন’-এ নানা সাজার কথা লিখেছেন সুকুমার রায়। প্রায় সেই পথে হেঁটেই এলাকার বিরোধীদের ঘাড় থেকে তৃণমূল বিরোধিতার ‘ভূত’ নামাতে শেখ সামিরুলের দাওয়াই—‘কান ধর, ওঠবোস কর’।

Advertisement

পীযূষ নন্দী

আরামবাগ শেষ আপডেট: ২৬ জুন ২০১৬ ০৮:৪৭
Share:

অঙ্কন: ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য

বোমা-বন্দুকে ডরানো? নেই। ঘরবাড়ি জ্বালানো, গ্রামছাড়া করা, ‘চড়াম, চড়াম’ বাদ্যিও একেবারে না-পসন্দ। ‘একুশে আইন’-এ নানা সাজার কথা লিখেছেন সুকুমার রায়। প্রায় সেই পথে হেঁটেই এলাকার বিরোধীদের ঘাড় থেকে তৃণমূল বিরোধিতার ‘ভূত’ নামাতে শেখ সামিরুলের দাওয়াই—‘কান ধর, ওঠবোস কর’।

Advertisement

আরামবাগের বাতানল পঞ্চায়েত এলাকার এই তৃণমূল নেতা বিরোধীদের মধ্যে তৃণমূল বিরোধিতার ‘মাত্রা’ এবং ‘রোগী’র বয়স বুঝে ওঠবোসের ‘ডোজ’ ঠিক করেন। কিমাশ্চর্যম! ‘আপস’ করতে আপত্তি নেই বিরোধী কর্মী-সমর্থকদের। সামিরুলের ‘নিদান’ অক্ষরে-অক্ষরে পালন করতে জগতিমাতা বাজারের তৃণমূল অফিসে ভিড় লেগেই রয়েছে।

কেমন সে ‘নিদান’?

Advertisement

লাল পতাকা নিয়ে সিপিএমের মিছিলে সামনে ছিলেন গ্রামের এক যুবক। তাঁর জন্য বরাদ্দ কড়া ‘ডোজ’— ৫০ বার কান ধরে ওঠবোস। মিছিলের পিছনে গুটিসুটি মেরে হাজির ছিলেন বৃদ্ধ? ‘রোগ’ ততটা মারাত্মক নয়! ১৫ বার কান ধরে ওঠবোস করলেই নিষ্কৃতি!

ঘরবাড়ি, পরিবার— বড় টান। তাই জোরালো প্রতিবাদ হচ্ছে না বাতানল পঞ্চায়েতের উত্তর রসুলপুর এবং পাশের শেখপুর গ্রামে। তবে বিরোধিতা যে হচ্ছে না তা নয়। আর তা করছেন তৃণমূল নেতাদেরই একাংশ। তাঁরা দুষছেন সামিরুলকে। তবে সামিরুলের হেলদোল নেই। বলছেন, ‘‘রমজান মাসে সন্ত্রাস এড়াতে মাথা খেলিয়ে পদ্ধতিটা আবিষ্কার করেছি। ওঁরা কার্যালয়ে এসে আমাদের দলের পতাকা একবার করে ঘাড়ে নিয়ে দোষ স্বীকার করছেন। এতে খারাপের কী আছে!”

খারাপের যে কিছু নেই —তা ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছেন সাজাপ্রাপ্তেরাও। বিশ্বনাথ রায় এবং তুহিন মালিকেরা বলেদিলেন, ‘‘প্রতিদিন ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকার চেয়ে এটাই ভাল। মারধর, লুঠপাট বা ঘরছাড়া করার চেয়ে কয়েকবার কান ধরে ওঠবোস করলেই স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে গ্রামে থাকতে পারছি। সামিরুলকে দয়ালুই বলতে হবে।” এলাকা ঘুরে বোঝা গিয়েছে, এই ‘দয়ালু’ নেতার বিরুদ্ধে থানা-পুলিশ করে হ্যাপা বাড়াতে চান না কেউ।

‘সাজা-পর্বে’র গোড়ায় কেউ কেউ একটু অস্বস্তিতে ছিলেন। হাঁটু কেঁপে গিয়েছিল মধ্য পঞ্চাশের নাসের আলির। এই বয়সে ২৫ বার কান ধরে ওঠবোস! ‘‘সাজাটা একটু কম হয় না?’’— ভয়ে ভয়ে প্রশ্নও করেছিলেন। সঙ্গে সঙ্গে সামিরুলের ধমক, ‘‘আমরা রাক্ষস নই। স্রেফ কান ধরে ওঠবোস করলেই ফাঁড়া কেটে যাবে।’’ নেতার স্যাঙাতেরা বুঝিয়ে দেন, শাস্তি নিয়ে কোনও প্রশ্ন নয়। প্রশ্ন করলে, ‘ফাঁড়া’। যেমন— গ্রামে কোনও অশান্তি হলেই প্রশ্নকর্তার নামে অভিযোগ হতে পারে থানায়। আর কথা বাড়াননি নাসের।

চল্লিশোর্ধ্ব জিতেন মালিক দীর্ঘদিন সিপিএম করছেন। তাঁর সাজা হয়েছে ১০ বার কান ধরে ওঠবোস। ভোটের সময় শ্যামল রায় শুধু সিপিএমের প্রচার-মিছিলে পা মিলিয়েছিলেন। তাঁর সাজা একটু বেশি। ৩০ বার। শ্যামলবাবু মাঝপথে হাঁফিয়ে পড়ে ‘রেস্ট’ চাওয়ায় চোখ পাকিয়ে তেড়ে এসেছিল কয়েকজন।

গ্রামের দলীয় কর্মী-সমর্থকেরা ‘সাজা’ মেনে নিলেও সিপিএমের আরামবাগ জোনাল কমিটির সম্পাদক পূর্ণেন্দু চট্টোপাধ্যায়ের কথায়, ‘‘কতটা অসহায় হলে তৃণমূলের এই বর্বরতা মানুষকে মেনে নিতে হয়, এটা তারই বড় প্রমাণ।” তা হলে সিপিএম কি এলাকায় গিয়ে পাশে দাঁড়াবে এই ‘সন্ত্রস্ত’দের? এ বার পূর্ণেন্দুবাবু বলেন, ‘‘দেখি, প্রশাসন কী করে!’’

সামিরুলের ‘পন্থা’য় আপত্তির কিছু দেখছেন না আরামবাগের তৃণমূল বিধায়ক কৃষ্ণচন্দ্র সাঁতরা। তাঁর বক্তব্য, ‘‘গ্রাম্য বিষয়। তবে যাঁরা নির্বাচনের আগে সিপিএম ফিরবে আশা করে সন্ত্রাস করেছিলেন, তাঁরা ক্ষমা স্বীকার করে গ্রামে স্বাভাবিক জীবনযাপন করার রাস্তা করে নিচ্ছেন।” তবে এই কাণ্ডে ক্ষুব্ধ দলের জেলা সভাপতি তথা কৃষি বিপণনমন্ত্রী তপন দাশগুপ্ত। তাঁর আশ্বাস, ‘‘এই নিষ্ঠুর আচরণ কে বা কারা করছে তা খোঁজ করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

‘‘আমি নিষ্ঠুর? কই, কেউ বলছেন না তো!’’— নেতার কথায় অবাক সামিরুল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন