বিষাদ: বুধবার বিকেলে খোঁড়া হয়েছিল তিনটি কবর। সে দিন রাতে সাহিল শেখের মৃত্যুর খবরে ফের খোঁড়া হল নতুন কবর। বৃহস্পতিবার সকালে। (ইনসেট, বাঁ দিক থেকে) দুর্ঘটনায় মৃত বাপি শেখ, মাসুক, আসিকুল ও সাহিল। নিজস্ব চিত্র
দিনদশেক আগে ছেলে আসিকুলকে মোটরবাইক কিনে দিয়েছিলেন অসিক শেখ। তিনি থাকেন মুম্বইয়ে। রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। সেলসম্যানের কাজ পেতে সুবিধা হবে, সে জন্যই ছেলেকে কিনে দিয়েছিলেন ওই মোটরবাইক।
বছরের প্রথম দিন সেই মোটরবাইকেই প্রতাপপুরে যেতে গিয়ে ভোল্লা ক্যানাল মোড়ের কাছে দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয় আসিকুল-সহ চার জনের। অসিক শুধু বলছেন, ‘‘মোটরবাইক না কিনে দিলে ছেলেকে হয়তো এ ভাবে হারাতাম না। বেঁচে যেত ওর বন্ধুরাও।’’
মঙ্গলবার রাতে আসিকুল আর বাপি শেখের দেহ মিলেছিল দুর্ঘটনাস্থলে। সাহিল শেখ নামে এক তরুণকে গুরুতর জখম অবস্থায় উদ্ধার করে কলকাতার হাসপাতালে পাঠানো হয়। মাসুক শেখ নামে তাঁদের অন্য বন্ধুর দেহ মেলে মাড়গ্রামের দুর্ঘটনাস্থল থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে— মহম্মদবাজারের সোঁতসালে। বুঝবার বিকেলে তিন বন্ধুর মৃতদেহ কবর দেওয়ার আগেই গ্রামে খবর আসে, সাহিলের অবস্থা আশঙ্কাজনক। রাতেই মারা যান তিনি।
বুধবার বোলপুরের প্রশাসনিক বৈঠকে জেলায় দুর্ঘটনা নিয়ে ক্ষোভপ্রকাশ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। জেলায় দুর্ঘটনায় মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে তাঁর হিসেবের সঙ্গে মেলেনি পুলিশ সুপারের তথ্য। জাতীয় সড়কের মতো গুরুত্বপূর্ণ রাস্তায় বিশেষত রাতের দিকে নজরদারি বাড়ানোর নির্দেশ আগেও দিয়েছিলেন মুখ্যমন্ত্রী। ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন মোটরবাইক, গাড়ির মত্ত চালক বা ট্রাক চালাতে গিয়ে ধরা পড়া লাইসেন্স-বিহীন খালাসিদের বিরুদ্ধে। বুধবারের বৈঠকে তিনি প্রশ্ন তোলেন, জেলার ব্যস্ত রাস্তায় নজর রাখতে টহলদারি গাড়ি, ওয়াচ টাওয়ার, জোরালো আলো, এলইডি বোর্ডে ‘সেভ ড্রাইড সেভ লাইফ’-এর বার্তা লেখার কথা বারবার বলা স্বত্বেও তা নিয়ে পুলিশ-প্রশাসন কতটা তৎপর হয়েছে? মুখ্যমন্ত্রীর ক্ষোভের মুখে পড়ে জেলার এসপি শ্যাম সিংহ জানান, পুলিশ এ বার থেকে আরও বেশি সতর্ক হবে।
জেলার বাসিন্দাদের একাংশের বক্তব্য, বর্ষবরণের রাত বা বছরের শুরুর দিন সাধারণত রাস্তায় মোটরবাইক বা গাড়ির দাপাদাপি অনেক বেশি থাকে— সে দিকে তাকিয়ে আগে থেকে আরও বেশি সতর্ক হলে হয়তো বিনোদপুরের মতো দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি এড়ানো যেত।
কুড়ি বছরের পুরনো কথা ঘুরছে বিনোদপুর গ্রামে। বাসিন্দারা জানান, ২০০০ সালের ২৭ জানুয়ারি সন্ধেয় প্রতাপপুরের মেলায় গান শুনে হেঁটে ফিরছিলেন চার বন্ধু। মাঝরাস্তায় নিয়ন্ত্রণহীন ট্রাকের ধাক্কায় রাস্তায় ছিটকে পড়েন চার জনই। রাতের অন্ধকারে কেউ তা টের পাননি। পরের দিন ভোরের আলো ফুটলে চারটি দেহের হদিস মেলে। মঙ্গলবার রাতে অবশ্য দুর্ঘটনার পরপরই খবর পৌঁছেছিল। স্থানীয় সূত্রে খবর, প্রতাপপুরে অনুষ্ঠানে যাওয়ার জন্যে গ্রাম থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৮টায় বেরিয়েছিলেন চার বন্ধু। ১৫ মিনিটের মধ্যেই ফোনে দুর্ঘটনার খবর পৌঁছয়।
বৃহস্পতিবার বিনোদপুরে ঢোকার মুখেই মানুষের জটলা। গ্রামবাসী ইশা হক, জাকির হোসেন, মহম্মদ সামিরুল বলেন—‘‘বাপি, মাসুক ও আসিকুল ছিল হরিহর আত্মা। মাসদেড়েক আগে গ্রামেরই ছেলে সাহিল পুনে থেকে ফেরে। সে-ও ওই দলে শামিল হয়।’’ স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, সাহিল পুনেয় কাজ করত। তাঁর পরিজনেরা বলছেন, ‘‘গ্রামে না ফিরলে হয়তো এমন হতো না।’’ মাসুকের বাবা-মা কর্মসূত্রে অজমেঢ়ে থাকেন। তাঁদের আক্ষেপ, ‘‘ছেলে মাধ্যমিক পরীক্ষা দেবে বলে আগে তাকে নিয়ে যাইনি। কয়েক দিনের মধ্যেই ওকে নিয়ে যেতাম। তার আগেই এমন হল।’’