স্কুলের ‘পাঠশালা’য় পড়ছেন অভিভাবকেরা

২০১৭ সালে শিক্ষক দিবসে ছেলেমেয়েদের প্রথম শিক্ষাগুরু হিসেবে মায়েদের সংবর্ধিত করা হয় ওই স্কুলে। সে দিনের মঞ্চ থেকেই শিক্ষানুরাগীরা মায়েদের শিক্ষাদানের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানান। তা মেনেই খোলা হয় আনন্দ পাঠশালা।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

সাঁইথিয়া শেষ আপডেট: ৩০ জুন ২০১৮ ০৭:১০
Share:

পড়ুয়া: ক্লাসে অভিভাবকেরা। সাঁইথিয়ায়। ছবি: কল্যাণ আচার্য

কারও বাবা ভ্যানচালক। কারও মা বাড়ি বাড়ি পরিচারিকার কাজ করেন। ছেলেমেয়েদের পড়াশোনা করাবেন কী, নিজেরাই ভাল করে স্বাক্ষরটুকুও করতে পারেন না। অনেকে প্রাথমিক স্কুলের গণ্ডিও পেরোননি। ছেলেমেয়েদের বাড়িতে পড়া বুঝিয়ে দেওয়ার কেউ নেই, না রয়েছে টাকা খরচ করে টিউশনি পড়ানোর সামর্থ্য। হতদরিদ্র ওই পরিবারের ছেলেমেয়েরা স্কুলের হোমওয়ার্ক করতে গিয়ে অসুবিধায় পড়ত। শিক্ষকের বকুনির ভয়ে স্কুল কামাইয়ের প্রবণতা ক্রমশ বাড়ছিল তাদের অনেকের মধ্যে।

Advertisement

তা রুখতে অভিনব উদ্যোগ নিল সাঁইথিয়ার ল’হাট প্রাথমিক বিদ্যালয়। ফলও মিলল হাতেনাতে। ৬ মাসে স্কুলে হাজিরা প্রায় ২০ শতাংশ বেড়েছে বলে দাবি স্কুল কর্তৃপক্ষের। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত প্রত্যন্ত এলাকার ওই স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ১৪৪। তাদের অনেকেই প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়া। কারও কারও অভিভাবকেরা শুধু স্বাক্ষরটুকু করতে জানেন। সন্তানদের শিক্ষা নিয়ে তাঁদের খুব বেশি নজর ছিল না। মূলত সরকারি সুযোগ-সুবিধার পেতে স্কুলের খাতায় ছেলেমেয়ের নাম লিখিয়েই দায়িত্ব পালন করতেন। স্কুলে পড়ুয়াদের হাজিরার প্রবণতা কমে যাচ্ছিল। তাতে চিন্তায় পড়েন শিক্ষকেরা।

স্কুলের তরফে পড়ুয়াদের মধ্যে সমীক্ষা করে জানা যায়— হোমওয়ার্ক না হওয়ায় অনেকে বকুনির ভয়ে স্কুলে আসে না। কোনও পড়ুয়ার অভিযোগ, বাড়িতে পড়াশোনার সময়ে অভিভাবকেরা তাদের দোকান পাঠান বা টেলিভিশনে অনুষ্ঠান দেখেন। তাতে সমস্যা হয়। এ সব নিয়ে অভিভাবকদের সঙ্গে কথাও বলেন শিক্ষকেরা। তাঁরা জানতে পারেন, নিজেরা অশিক্ষিত হওয়ায় ছেলেমেয়েদের পড়াশোনায় সাহায্য করা দূর, এক রকম হীনমন্যতা থেকে ছেলেমেয়েদের কিছু বলতেও পারেন না। তা কাটাতেই এ বছর জানুয়ারি মাস থেকে ওই স্কুলে শুরু হয় অভিভাবকদের নিয়ে বিশেষ সচেতনতা শিবির। পোশাকি নাম ‘আনন্দ পাঠশালা’। প্রতি মাসের প্রথম ও তৃতীয় শনিবার স্কুলের ছুটির পর পাঠশালা বসে।

Advertisement

ওই চিন্তা অবশ্য আরও আগের। ২০১৭ সালে শিক্ষক দিবসে ছেলেমেয়েদের প্রথম শিক্ষাগুরু হিসেবে মায়েদের সংবর্ধিত করা হয় ওই স্কুলে। সে দিনের মঞ্চ থেকেই শিক্ষানুরাগীরা মায়েদের শিক্ষাদানের উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানান। তা মেনেই খোলা হয় আনন্দ পাঠশালা।

কেমন সেই পাঠশালা?

তার দায়িত্বপ্রাপ্ত মহম্মদ সামাউল ও রুবাইয়া খাতুন জানান, সারা মাস ধরে পড়ুয়াদের পর্যবেক্ষণ করে তাদের আগ্রহ ও সমস্যার কথা লিখে রাখা হয়। আনন্দ পাঠশালায় অভিভাবকদের সামনে তা তুলে ধরা হয়। কী ভাবে তার সমাধান করতে হবে তা-ও জানানো হয়। তাঁদের পাঠদানও করা হয়। তাতে অনেক অভিভাবকই পড়াশোনা না জানার হীনমন্যতা কাটিয়েছেন।

আত্মবিশ্বাস বেড়েছে হাজেরা বিবি, নীহার বিবি, জালান খানের। তাঁরা বলেন— ‘‘সামান্য যে লেখাপড়া করেছিলাম, তা চর্চার অভাবে ভুলতে বসেছিলাম। আনন্দ পাঠশালার দৌলতে তা ফের ঝালিয়ে নিয়ে ছেলেমেয়েদের পড়াতে পারছি।’’

খুশি ছেলেমেয়েরাও। প্রথম শ্রেণির নাজবুল শেখ, রাজিয়া সুলতানা জানায়, আগে হোমওয়ার্ক শেষ হতো না বলে স্কুলে আসতে ভয় পেত। এখন বাবা-মা সাহায্য করায় হোমওয়ার্ক শেষ হচ্ছে সময়মতোই।

স্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক কৌশিক ভট্টাচার্য, সহকারী শিক্ষিক ফাল্গুনী সূত্রধর জানান, আনন্দ পাঠশালা চালু করার আগে দৈনিক পড়ুয়াদের গড় হাজিরা ছিল ৫৫-৬০ শতাংশ। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৮০-৮৫ শতাংশ।

উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে জেলা স্কুল বোর্ডের চেয়ারম্যান রাজা ঘোষ জানান, বোর্ডের পক্ষ থেকেও ২০১৫ সাল থেকে মাসে এক দিন একটি চক্রের ৫ জন শিক্ষককে নিয়ে ওই রকম শিবির করা হয়।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন