মহিলাকে মেরেছে, গুজবেই রোষের বলি সেই চিতাবাঘ

গ্রামে আচমকা হানা দিয়ে একটি চিতাবাঘ এক মহিলাকে মেরে ফেলেছে, শনিবার দুপুরে এই গুজবই কোনও ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল কোটশিলার দক্ষিণ টাটুয়াড়া গ্রামে। আর সেই খবর পেয়েই শয়ে শয়ে লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিলেন সেই বাড়ির সামনে, যেটির ভিতরে ঢুকে পড়েছিল পূর্ণবয়স্ক চিতাবাঘটি। তার পরেই শুরু হয় গণপিটুনি। নৃশংস ভাবে মেরে চিতাবাঘটিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় গাছে।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২২ জুন ২০১৫ ০২:০৭
Share:

দাহ করা হচ্ছে চিতাবাঘটিকে। কোটশিলায় শনিবার রাতে। — নিজস্ব চিত্র

গ্রামে আচমকা হানা দিয়ে একটি চিতাবাঘ এক মহিলাকে মেরে ফেলেছে, শনিবার দুপুরে এই গুজবই কোনও ভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল কোটশিলার দক্ষিণ টাটুয়াড়া গ্রামে। আর সেই খবর পেয়েই শয়ে শয়ে লোক জড়ো হয়ে গিয়েছিলেন সেই বাড়ির সামনে, যেটির ভিতরে ঢুকে পড়েছিল পূর্ণবয়স্ক চিতাবাঘটি। তার পরেই শুরু হয় গণপিটুনি। নৃশংস ভাবে মেরে চিতাবাঘটিকে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় গাছে।

Advertisement

‘অরণ্য ভবন’-এ এই মর্মেই রিপোর্ট পাঠাচ্ছে পুরুলিয়া বন দফতর। জনতা চিতাবাঘটির সমস্ত নখ উপড়ে নিয়েছে, কেটে নিয়েছে লেজও। তাই বন্যপ্রাণ সুরক্ষা আইন ১৯৭২ মোতাবেক কোটশিলা থানায় এফআইআর করেছে বন দফতর। তবে, কারও নামে নয়, অভিয়োগ দায়ের করা হয়েছে অজ্ঞাতপরিচয় দুষ্কৃতীদের নামে। বন দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘এ বার আমরা খতিয়ে দেখব, কারা এই নৃশংস ঘটনার সঙ্গে জড়িত।’’ দফতর সূত্রে জানা যাচ্ছে, অরণ্য ভবনে যে রিপোর্ট পাঠানো হবে, তাতে বলা হবে, এলাকায় বাঘ বা আধবাঘা (হায়না) ঢুকে পড়েছে এবং তার আক্রমণে কয়েক জন গ্রামবাসী জখম হয়েছেন, এমন খবর পেয়ে বন দফতরের বেশ কয়েকজন কর্মী শনিবার ঘটনার সময় দক্ষণি টাটুয়াড়া গ্রামে হাজির ছিলেন। কিন্তু, কযেকশো গ্রামবাসীর রোষের কাছে তাঁরা রীতিমমতো অসহায় হয়ে পড়েছিলেন। বনকর্মী এবং গুটি কয়েক পুলিশ কর্মীর উপস্থিতিতেই উন্মত্ত জনতা চিতাবাঘটিকে পিটিয়ে মেরে চ্যাংদোলা করে গ্রামের এক প্রান্তে নিয়ে গিয়ে একটি নিম গাছে ঝুলিয়ে দেয়। তার পর চারটি পায়ের থাবা থেকে নখ ও লেজ কেটে নেয়।

শনিবারের ওই ঘটনা থেকে শিক্ষা নিয়েছে বন দফতর। পুরুলিয়ার ডিএফও ওমপ্রকাশ রবিবার জানিয়েছেন, গ্রামে বা লোকালয়ে এ ভাবে কোনও বন্যপ্রাণী আচমকা ঢুকে পড়লে তাকে আহত বা প্রাণে না মেরে বনকর্মীদের যাঁরা খবর দেবেন, তাঁদের তাঁদের পুরস্কৃত করার কথা ফের গ্রামে গ্রামে প্রচার করবে বন দফতর। তিনি বলেন, ‘‘গ্রামে বন্যপ্রাণ ঢুকে পড়লে গ্রামবাসীরা যে সব সময় তাদের পিটিয়ে মারেন, এমন নয়। বিভিন্ন সময়ে হরিণ বা হায়নাকে আমাদের হাতে তুলেও দিয়েছেন গ্রামবাসীরা। আমরা তাঁদের বন্যপ্রাণ সপ্তাহে পুরস্কৃতও করি। আবার কখনও কখনও বন্যপ্রাণকে পিটিয়ে মারা হয়। যেমন শনিবার ঘটেছে। এ ক্ষেত্রে রটে গিয়েছিল চিতাবাঘটি একটি মহিলাকে মেরেছে। তাই শয়ে শয়ে লোকজন জুটে গিয়েছিল লাঠিসোঁটা নিয়ে।’’ তাঁর আক্ষেপ, একটি বাড়িতে চিতাবাঘটি আশ্রয় নিয়েছিল। চিতাবাঘটি কয়েক জনকে জখম করেছিল সত্যি। কিন্তু ওকে রক্ষা করা গেলে ভাল হত। ডিএফও-র কথায়, ‘‘আমরা বন সুরক্ষা কমিটিগুলির মাধ্যমে আরও সতেচনতা প্রচারের কাজ করব। পাশাপাশি এলাকাগুলিতে আরও ফলক লাগানো হবে, যাতে এ ভাবে কোনও বন্যপ্রাণ এলাকায় ঢুকে পড়লে তাকে না মেরে বনকর্মীদের খবর দেওয়া হয়।’’ শনিবার ঘটনাস্থলে থাকা বন দফতরের এক আধিকারিক বলেন, ‘‘কোটশিলার ওই গ্রামটি এমনই গোলকধাঁধার মতো যে চিতাবাঘটির পক্ষে পালিয়ে বাঁচা সম্ভব ছিল না। গ্রামে ঢুকেই সে আটকে গিয়েছিল। তার উপরে উন্মত্ত জনতা। মানুষের সচেতনতা ছাড়া এ ধরনের ক্ষেত্রে কোনও বন্য প্রাণীর প্রাণে বাঁচা মুশকিল।’’

Advertisement

শনিবার রাতেই চার ফুট দু’ইঞ্চি লম্বা চিতাবাঘটিকে কোটশিলায় ময়নাতদন্ত করে দাহ করা হয়। ডিএফও জানিয়েছেন, ভারী কোনও বস্তু দিয়ে এবং ধারালো অস্ত্র দিয়ে চিতাবাঘটির মাথায় বারবার আঘাত করা হয়েছিল। প্রাথমিক ভাবে মনে করা হচ্ছে, ওই আঘাতের ফলেই চিতাবাঘটির মৃত্যু হয়েছে। তবে সেটির ভিসেরাও সংগ্রহ করেছে বন দফতর। ভিসেরা পরীক্ষা করা হবে। এই চিতাবাঘটি অবশ্য এখানকার জঙ্গলে একদম নতুন নয়। ডিএফও বলেন, ‘‘অযোধ্যা থেকে ঝালদা, এই বানঞ্চলে এ ধরনের চিতাবাঘের একেবারে দেখা মেলে না, এমন নয়।’’ কোটশিলার ভারপ্রাপ্ত রেঞ্জার সমীর বসু জানান, ঝাড়খণ্ডের হাজারিবাগের জঙ্গল যেহেতু দক্ষিণ টাটুয়াড়া গ্রাম থেকে দশ-বারো কিলোমিটার দূরে, তাই সেখানকার জঙ্গল থেকে চিতাবাঘটি এই এলাকায় এসে থাকতে পারে।

ও দিকে, চিতাবাঘকে মেরে ফেলারও পরেও আতঙ্ক কাটেনি দক্ষিণ টাটুয়াড়ার বাসিন্দাদের। একাধিক গ্রামবাসী বলেন, ‘‘এখনও কেউ একা একা বেরোতে পারছে না। সন্ধ্যার পরে গ্রাম লাগোয়া রাস্তা সুনসান হয়ে যাচ্ছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন