কবির দেশে এসে বাউলে ভাসলেন বাকে সাহেব

যে সুরের জন্ম মাঠে-ঘাটে-নদীর বাটে, তা মাঠ-ঘাট পেরিয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে যায়। মরা সরস্বতীর মতো কোথাও বালিতে মুখ গুঁজে বহু দূরে অভাবিত শত জল ঝর্নার উৎসারে ছিটকে ওঠে।

Advertisement

নিজস্ব প্রতিবেদন

শেষ আপডেট: ০৮ মার্চ ২০১৬ ০১:৫৭
Share:

সাধনায় মগ্ন আর্নল্ড বাকে।

যে সুরের জন্ম মাঠে-ঘাটে-নদীর বাটে, তা মাঠ-ঘাট পেরিয়ে দেশ থেকে দেশান্তরে যায়। মরা সরস্বতীর মতো কোথাও বালিতে মুখ গুঁজে বহু দূরে অভাবিত শত জল ঝর্নার উৎসারে ছিটকে ওঠে।

Advertisement

সে সুরে যাঁর প্রাণ মজে, তিনিও যান পিছু-পিছু। দেশের-কালের সীমা পার করে খুঁজে ফেরেন পদচিহ্ন। ঠাহর করে নিতে চান কথার চাল, সুরের মায়া, গায়নের মেজাজ-মর্জি। পথ হারালে বল্গাছাড়া সুরই ফের পথ দেখিয়ে নিয়ে যায়।

দামোদর মিশ্রের ‘সঙ্গীতদর্পণ’ নিয়ে গবেষণা করতে শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছেছিলেন এক ওলন্দাজ সাহেব। সালটা ১৯২৫। বিহারে সদ্য মারা গিয়েছেন জ্যোতিরিন্দ্রনাথ। ‘রক্তকরবী’ কয়েক বার চেলে লেখা হয়ে গিয়েছে রবীন্দ্রনাথের। আর, গুটি-গুটি পায়ে কলাভবনে এসে গুরু নন্দলালের কাছে নাড়া বেঁধেছেন বছর উনিশের এক আদিবাসী যুবক— রামকিঙ্কর বেইজ।

Advertisement

এরই মধ্যে এসে পড়লেন তিনি—আর্নল্ড বাকে। নিজের দেশ থেকে সংস্কৃতটা শিখেই এসেছেন। এ বার শুধু কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ার অপেক্ষা। পড়লেনও। কিন্তু দোরগোড়াতেই যে অপেক্ষা করছিল ‘অকাজ’— বাউল-ফকিরের ভুঁইয়ে সব ‘কাজ’ ভোলানো সুরের মায়া। ঘরছাড়া করাই তার স্বভাব। জাতপাত, ভাষা, চামড়ার রং মানে না। রবীন্দ্রনাথ কবেই মজেছেন লালনে। বাকেও মজে গেলেন।

শুরু হল সুরের পিছনে ধাওয়া করা। সাহেবকে নিশির মতো টেনেছে বাউল আর কীর্তন। একটু-একটু করে তিনি তলিয়ে যাচ্ছেন রসে। সংস্কৃতের চৌকাঠ পেরিয়ে ঢুকে পড়ছেন এ দেশের মুখের ভাষা, প্রাণের সুরের আঙিনায়। প্রথম বার দেখছেন, পরখ করছেন নানা বাদ্যযন্ত্র। তিলে তিলে সংগ্রহ করছেন খুঁটিনাটি তথ্য। কাজ করছেন কবির ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে। পড়ছেন, হৃদয়ঙ্গম করার চেষ্টা করছেন রবীন্দ্রনাথের গান আর কবিতা।

এই করতে-করতেই কেটে গেল প্রায় তিরিশটা বছর। এর মধ্যে কবির প্রয়াণ হয়েছে। কিন্তু বাকে অক্লান্ত। শুধু শান্তিনিকেতন নয়, গ্রামবাংলা জুড়ে চষে বেরিয়েছেন তিনি। অসীম ধৈর্যে রেকর্ড করেছেন মেঠো গান। শিল্পীকে স্টুডিওয় এনে নয়, সরাসরি মাঠ থেকেই। ভারতের গণ্ডী ছাড়িয়ে এক দিকে শ্রীলঙ্কা, অন্য দিকে নেপাল পর্যন্ত চলে গিয়েছেন লোকগানের টানে। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত টানা তিন দশকে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দিয়েছেন এই উপমহাদেশে।

এ মাটির গান ভালবেসে অমর হয়ে গিয়েছেন অ্যান্টনি ফিরিঙ্গি। সে হয়তো তিনি নিজে কবিয়াল বলে। কিন্তু আর্নল্ড বাকে সাহেবকে এ দেশ মনে রাখেনি। বাংলা তো নয়ই। কারও তাঁকে মনেও পড়ত না যদি না একই সাধনায় ব্রতী দুই বাঙালি হঠাৎ ব্রিটিশ লাইব্রেরিতে খুঁজে পেতেন কিছু রেকর্ডিং, চমকে উঠতেন, সহবাস করতেন সেই সব হারিয়ে যাওয়া শব্দের সঙ্গে এবং নিখাদ ভালবাসায় তা নিয়ে আসতেন সর্বসমক্ষে।

ওঁরা দু’জন— এক জনকে বাঙালি চেনে তাঁর আশ্চর্য সুলিখিত গান ও গায়কীর জন্য, মৌসুমী ভৌমিক। অন্য জন শব্দশিল্পী সুকান্ত মজুমদার, যিনি গান কথা শব্দ রেকর্ড করে নিজের খলনুড়িতে নেড়ে-ঘেঁটে-মিশিয়ে তৈরি করে ফেলেন ধ্বনিময় চালচিত্র। সেই ২০০৩ থেকে দু’জনকেই নিশিতে পেয়েছে। সীমানা ভাসিয়ে বয়ে চলা লোকগানের পিছু নিয়ে তাঁরা কখনও পৌঁছেছেন বাংলাদেশে, তো কখনও লন্ডনে। সুকান্তর ‘ফিল্ড রেকর্ডিং’ সিলেট থেকে তুলে এনেছে চন্দ্রাবতী রায় ও সুষমা দাশের কণ্ঠ। অ্যালবাম হিসেবে ইতিমধ্যেই প্রকাশিত হয়েছে তা। আবার ‘সময়ের শব্দে শক্তি চট্টোপাধ্যায়’ অ্যালবামে কবিতা-মাখা সেই যুগটিকেও তাঁরা ধরে রেখেছেন। thetravellingarchive.org ওয়েবসাইট মারফত নিয়ত হদিস দিয়ে চলেছেন তাঁদের পথ চলার।

আসলে, যে পথে লোকে সচরাচর হাঁটে না, আর্নল্ড বাকের ফেলে যাওয়া সেই কঠিন পথেই হাঁটছেন মৌসুমী-সুকান্ত। তাই অবাক লাগে না, বাকের কাজ নিয়ে তাঁরা যখন আয়োজন করে ফেলেন বিস্তৃত প্রদর্শনীর এবং তার জন্য দেশ-বিদেশের নানা আর্কাইভ তোলপাড় করে ফেলেন। সোমবার থেকে শান্তিনিকেতেনের কলাভবনে, নন্দন আর্ট গ্যালারিতে শুরু হয়েছে সেই প্রদর্শনী: টাইম আপন টাইম।

এক সময় যেন দীর্ঘ ছায়া ফেলেছে অন্য সময়ের উপরে। এ যেন আসলে এক গুরুদক্ষিণাই।

(সঙ্গের ছবিটি লাইডেন বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের বিশেষ সংগ্রহ থেকে প্রাপ্ত)

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন