আবার বয়ান বদল করে দলকে চিঠি লিখলেন অনুব্রত মণ্ডল। গ্রাফিক: আনন্দবাজার ডট কম।
দলের নির্দেশে লিখিত ভাবে পুলিশের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়েছেন ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ তৃণমূল নেতা অনুব্রত মণ্ডল। তার পর ভিডিয়োবার্তা দিয়েও পুলিশের কাছে মাফ চাইলেন তিনি। মেনে নিলেন ভাইরাল হওয়া অডিয়ো ক্লিপ ‘অনুব্রত মণ্ডল বলছি’ বলে যে কণ্ঠ শোনা গিয়েছে, সেটা তাঁরই। তৃণমূল নেতার দাবি, পুলিশ-প্রশাসনের সঙ্গে বরাবরই তাঁর সুসম্পর্ক। পুলিশকে নিয়ে কখনও খারাপ কথা বলেন না। কিন্তু ‘সে দিন’ অন্য একটি ঘটনা ঘটেছিল।
একই সঙ্গে দলের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করে প্রথম চিঠি দেওয়ার মিনিট ৫০ পরে দ্বিতীয় চিঠি পাঠিয়েছেন অনুব্রত। সেখানে তাঁর বক্তব্য আরও সংক্ষিপ্ত। তৃণমূল সূত্রে খবর, অনুব্রতকে বয়ান বদল করিয়ে আবার চিঠি পাঠাতে বলেন শীর্ষ নেতৃত্বই। উল্লেখ্য, বোলপুর থানার আইসি-কে ‘হুমকি’ দেওয়ার অভিযোগ নিয়ে শুক্রবার সকালে অনুব্রতের সঙ্গে যোগাযোগ করে আনন্দবাজার ডট কম। তখন তিনি জানান, ভাইরাল অডিয়োয় যে কণ্ঠস্বর শোনা গিয়েছে, সেটা তাঁর নয়। তিনি বলেছিলেন, ‘‘আমি কেন আইসিকে হুমকি দেব? আইসি এক জনকে মেরে হাত-পা ভেঙে দিয়েছে। আমি ফোন করলে বলে, ফোন রাখ।’’
কিন্তু বেলা গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায় কেষ্টর বয়ান। শুক্রবার দুপুরে দলের তরফে অনুব্রতকে চার ঘণ্টা সময় দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, নিঃশর্তে ক্ষমা চাইতে। তার মিনিট চল্লিশের মধ্যে লিখিত ভাবে ক্ষমা চান অনুব্রত। তার কিছু ক্ষণ বাদে ভিডিয়োবার্তাতেও পুলিশের কাছে মাফ চান। বীরভূমের তৃণমূল নেতা বলেন, ‘‘পুলিশের বড়কর্তা যাঁরা আছেন, তাঁরা সকলে ‘দিদি’কে (মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) ভালবাসেন। আর পুলিশকে আমি প্রচণ্ড সাহায্য করি। পুলিশকে আমি ভালবাসি। পুলিশ বিপদে পড়লে আমি তাদের পাশে দাঁড়াই। পুলিশকে গাল দেওয়ার কথা আমি কোনও দিন ভাবতেই পারিনি। কেউ যদি পুলিশকে গালাগালি দেয় আমি তাকে অপমান করি। এটা আমার বরাবরের স্বভাব। যখন যে এসপি, এসডিপিও যা বলেছেন, দেখেছি। যে-ই বলেছেন, ‘এঁকে দেখে দিন।’ আমি দেখে দিয়েছি। কখনও ঝগড়াঝাঁটি হয়নি।’’
তার পর হুমকি-অডিয়ো প্রসঙ্গে কেষ্ট ব্যাখ্যায় চলে যান। তিনি বলেন, ‘‘রাতে অনেক ওষুধপত্র খাই তো! এখন আমি রাত ১০টায় ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের ওষুধ খেতে হয় আমাকে। সে দিন (জানা যাচ্ছে, দিন দুয়েক আগে) নুরুল নামে আমাদের এক কর্মীর ছেলে আমাকে জানায়, মেরে ওর হাত-পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। তখন আমার মনটা খারাপ হয়ে যায়। আমি আইসি-কে ফোন করে বলেছিলাম, ‘আপনি যান, ছেলেটাকে ছাড়িয়ে আনুন।’ তখন উনি আমায় একটা অন্য ধরনের কথা বলেন। সেটা এখন বলতে রাজি নই। তখন আমি নিজের রাগ সামলাতে পারিনি। আমি এই কথা বলেছি। সে জন্য আমি দুঃখিত।’’
অন্য দিকে, ৩টা ১০ মিনিটে পাঠানো চিঠিতে অনুব্রত লিখেছিলেন, ‘‘সাম্প্রতিক ঘটনায় আমি দুঃখিত। দিদির পুলিশের কাছে এক বার কেন, একশো বার ক্ষমা চাইতে পারি। আসলে আমি নানা রকম ওষুধ খাই। দিদির পুলিশের বিরুদ্ধে কেউ কোনও অভিযোগ করলে মাথা গরম হয়ে যায়। সত্যিই আমি দুঃখিত।’’ ৫০ মিনিট পরে বয়ান বদল করে আবার চিঠি লেখেন তিনি। ৪টের সময় লেখা ওই চিঠিটি তৃণমূলের সভাপতি সুব্রত বক্সীকে উদ্দেশ করে। দু’লাইনের চিঠিতে কেষ্ট লিখেছেন, ‘‘আশা করি ভাল আছো। আমার প্রণাম নিও। সাম্প্রতিক ঘটনার জন্য আমি সামগ্রিক ভাবে সমস্ত স্তরের কাছে নিঃশর্ত ভাবে ক্ষমাপ্রার্থী।’’ তৃণমূল সূত্রে খবর, প্রথম চিঠি পাঠানোর পর অনুব্রকে বলা হয়েছিল, তাঁর দীর্ঘ বক্তব্য জানতে চায়নি দল। চিঠির বয়ান ছোট করে নিঃশর্ত ভাবে ক্ষমা চাইতে হবে তাঁকে। কেষ্ট তা মেনে নিয়ে চিঠিটি লিখেছেন।
পুলিশ সূত্রে খবর, আইসি-কে হুমকি এবং অশ্লীল ভাষা প্রয়োগের অভিযোগে অনুব্রতের বিরুদ্ধে ভারতীয় ন্যায় সংহিতা (বিএনএস)-র ২২৪ (সরকারি কাজে বাধা দেওয়া ও কর্তব্যরত কর্মীকে হুমকি), ১৩২ (সরকারি কর্মচারীকে হেনস্থা), ৭৫ (শ্লীলতাহানি ও হেনস্থা) এবং ৩৫১ (হুমকি) ধারায় মামলা রুজু হয়েছে। বিকেলে তৃণমূলের দলীয় কার্যালয়ে গিয়ে অনুব্রতকে নোটিস দিয়ে আসে পুলিশ। জেলা পুলিশ সুপার আমনদীপ জানান, অভিযোগ খতিয়ে দেখে কড়া পদক্ষেপ করা হবে। অনুব্রত ইস্যুতে তৃণমূল তথা রাজ্য পুলিশকে খোঁচা দিয়েছেন বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। তিনি বলেন, ‘‘তৃণমূল যে পুলিশকে তাদের দলদাসে পরিণত করেছে, এই ঘটনা তারই প্রমাণ। যে অফিসার ওদের সব কথা মেনে চলেন না, তাঁকে এই ভাবে গালিগালাজ করা হয়। তাই আর ক্ষমা চাওয়ার ন্যাকামি নয়, কেষ্টকে গ্রেফতার করুক পুলিশ।’’ তিনি জানান, অনুব্রতর ‘কুমন্তব্যের’ নিন্দা করে পথে নামবে বিজেপি।
বিজেপির রাজ্য দফতরে সাংবাদিক বৈঠকে শুভেন্দু জানান, আগামী ৯ জুন বোলপুরে বিজেপি প্রতিবাদ মিছিল করবে। নেতৃত্বে থাকবেন তিনি। পাশাপাশি বিরোধী দলনেতার দাবি, বোলপুর থানার আইসি কেষ্টর সঙ্গে তাঁর কথোপকথন রেকর্ড করে বীরভূম জেলা পরিষদের সভাধিপতি কাজল শেখকে দিয়েছিলেন। কাজল তা ছড়িয়ে দেন বাইরে। এতে তৃণমূল অস্বস্তিতে পড়েছে। এখন বোলপুরের আইসি-কে সাসপেন্ড করার চেষ্টা চলছে বলে অভিযোগ করেছেন শুভেন্দু। বিরোধী দলনেতা বলেন, ‘‘আমরা কথা দিলাম, ২০২৬ সালে আমাদের ক্ষমতায় আনুন। শপথ নেওয়ার পরের দিনই অনুব্রতর বিরুদ্ধে এফআইআরের ফাইল আবার খুলব, ওকে জেলে ঢোকাব।’’ উল্লেখ্য,দলকে পাঠানো প্রথম চিঠিতে অনুব্রত অভিযোগ করেন, তাঁর ও আইসি-র ফোনের কথোপকথন বাইরে আনার ব্যাপারে হাত থাকতে পারে বিজেপি-র। আবার ওই অডিয়ো-তে আইসি-কে কেষ্ট প্রশ্ন করেন, তিনি ‘কাজলের লোক’ কি না।