পাচারও হয়ে যাচ্ছে পুরা নিদর্শন

গৃহকর্তা স্কুল শিক্ষক। তাঁর বারান্দায় বসতে গিয়েই চক্ষু চড়কগাছ। ঢালাইয়ের স্তম্ভের উপরে পাতা যে পাথরের উপর গৃহকর্তা বসতে বলছেন, সেটা যে আস্ত একটা পুরাকীর্তি! সেই পাথরের চাঁইয়ে কোনও মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। দীর্ঘ ব্যবহারে সেই পুরকৃতির অনেকটাই তখন ক্ষয়ে দিয়েছে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় বুঝতে অসুবিধা হল না আস্ত একটা পুরা নিদর্শনের উপর আমাকে বসতে দেওয়া হয়েছিল।

Advertisement

সমীর দত্ত

পুঞ্চা শেষ আপডেট: ১৮ মার্চ ২০১৫ ০১:২৩
Share:

পাকবিড়রায় শুরু হয়েছে সংস্কার। কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণ ও নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। ছবি: প্রদীপ মাহাতো।

গৃহকর্তা স্কুল শিক্ষক। তাঁর বারান্দায় বসতে গিয়েই চক্ষু চড়কগাছ। ঢালাইয়ের স্তম্ভের উপরে পাতা যে পাথরের উপর গৃহকর্তা বসতে বলছেন, সেটা যে আস্ত একটা পুরাকীর্তি! সেই পাথরের চাঁইয়ে কোনও মূর্তি খোদাই করা রয়েছে। দীর্ঘ ব্যবহারে সেই পুরকৃতির অনেকটাই তখন ক্ষয়ে দিয়েছে। পড়ন্ত বিকেলের আলোয় বুঝতে অসুবিধা হল না আস্ত একটা পুরা নিদর্শনের উপর আমাকে বসতে দেওয়া হয়েছিল।

Advertisement

পুঞ্চার পাকবিড়রা, টুসামা, বুধপুর, গোয়ালাপাড়া, রতনাডির মতো এ রকম আরও বহু গ্রাম আছে, যেখানে বাড়ি তৈরির সময় কাছাকাছি পড়ে থাকা পাথরের চাঁই দেওয়াল এবং ভিত তৈরির কাজে ব্যবহার হয়েছে। এই ধরনের পাথরের চাঁইয়ের গায়ে খোদাই করা নিদর্শনের ঐতিহাসিক মূল্য অনেকেই বোঝেননি। ফলে অজান্তেই বহু মূল্যবান পুরাকীর্তি নষ্ট হয়েছে।

পুঞ্চার একটি গ্রামের তেমাথায় একটি বড় পাথরের স্তম্ভ মাটিতে পোঁতা আছে। কে বা কারা গ্রামের মাথায় ওই পাথরের স্তম্ভ বসিয়েছিলেন জানা যায়নি।। তবে একটু লক্ষ করলেই বোঝা যা। ওটা সাধারণ আর পাঁচটা পাথরের স্তম্ভের মতো নয়। উপরের দিকের অংশে চারটি খাঁজ রয়েছে। মসৃন ভাবে কাটা। তলার অংশে খোদাই করা মূর্তির ছাপ। তবে রোদ-বৃষ্টি এবং অযত্নে কীসের মূর্তি এখন বোঝা যায় না। তলার দিকে পাথরের একটা অংশ বেশ ক্ষয়ে এসেছে। এলাকার বাসিন্দাদের একাংশ জানালেন, কাটারি-দা কিংবা কুড়ুলের ধার কমে এলে ওই পাথরে ঘসে ধার ফেরানো হয়।

Advertisement

ইতিহাস গবেষক তথা মানভূম কলেজের অধ্যাপক প্রদীপ মণ্ডলের মতে, ব্রিটিশ শাসনের আগে এই এলাকা জঙ্গলমহল নামে পরিচিত ছিল। তথাকথিত অরণ্যচারী আদিবাসীদের মধ্যে জৈন ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে ধর্ম প্রচারকরা এখানে এসেছিলেন। মূলত কংসাবতী নদীর দু’পাড় ঘিরে জৈন ধর্মের প্রসার ও প্রচার ঘটে। স্থানীয় সামন্ত প্রভুরাও জৈন ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। তীর্থঙ্কররা এই এলাকায় ধর্ম প্রচারের উদ্দেশ্যে পরিভ্রমণ করেছিলেন। পরবর্তীকালে স্থানীয় রাজ অনুগ্রহে জৈন স্থাপত্যও গড়ে ওঠে। পুঞ্চা থানা এলাকার প্রায় সর্বত্র সেই সব জৈন স্থাপত্যের নির্দশন এখনও ছড়িয়ে রয়েছে।

বাসিন্দাদের কাছে এ সব পুরাকীর্তির মূল্য বিশেষ না থাকলেও যাঁরা এ সম্বন্ধে খোঁজখবর রাখেন, তাঁরা হদিস পেয়ে গিয়েছেন। চোরা কারবারিদের নজরও এসে পড়েছে পুঞ্চায়। ২০১৪ সালের ১ জানুয়ারি সাতসকালে পুঞ্চা থানায় খবর গেল পাকবিড়রা থেকে বেশ কয়েকটি পুরা নিদর্শন চুরি হয়েছে। গাড়িতে তোলার সময় অসতর্কতায় দু’-একটি নিদর্শন পড়ে যায়। দুষ্কৃতীরা সম্ভবত সেগুলো তুলে নিয়ে যাওয়ার আর সময় পায়নি।

পুঞ্চা থানা এলাকার পাকবিড়রা গ্রামে সব থেকে বেশি পুরা নিদর্শন রয়েছে। এখনও এলাকায় তিনটি বড় দেউল রয়েছে। দেউলের গায়ে খোদাই করা শিল্প কীর্তি দেখলে মুগ্ধ হতে হয়। বড় দেউলের আদলে ছোট আকারের অনেকগুলি দেউল এবং মূর্তি ছিল। এ সব রক্ষার জন্য বাসিন্দারা নিজেদের উদ্যোগে গড়ে তুলেছিলেন পাকবিড়রা পুরাকীর্তি সংরক্ষণ কমিটি। সেই কমিটি এখন আর নেই। কমিটির প্রাক্তন সম্পাদক হরিপদ মাহাতোর আক্ষেপ, “আমরা অনেকদিন ওই পুরা সম্পদ আগলে রেখেছিলাম। সম্পদ সংরক্ষণে সরকারি সহায়তা না পাওয়ায় আমাদের পক্ষে একক ভাবে কাজ করা সমস্যা হয়ে ওঠে। কমিটিও একসময় উঠে গিয়েছে।”

সংরক্ষণ কমিটির এক সদস্যের কথায়, ছোট-বড় মিলিয়ে ২৫০-র মতো নিদর্শনের তালিকা তাঁরা তৈরি করেছিলেন। যদিও এখন তার বেশির ভাগ নিদর্শন উধাও হয়ে গিয়েছে। গ্রামের বাসিন্দারাই পালা করে পুরাকীতির্র্ সংরক্ষণ কমিটি গড়ে পুরা নিদর্শনগুলি রক্ষা করে এসেছেন। প্রায় এক দশক হল সেই উদ্যোগেও ভাটা পড়েছে। বাসিন্দাদের একাংশের অভিযোগ, প্রত্নসামগ্রী রক্ষায় সরকারি উদ্যোগ নেই। অথচ উপযুক্ত ভাবে সংরক্ষণ করা গেলে একে ঘিরেই পুঞ্চায় পর্যটনের বিরাট সম্ভাবনা ছিল। এখনও যেটুকু রয়ে গিয়েছে, তা নিয়েও সংরক্ষণের সরকারি উদ্যোগ চোখে পড়ে না। এলাকার প্রবীন বাসিন্দারা বলেন, “দু’দশক আগেও দেউল চত্বর এলাকায় এবং গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় পুরা নিদর্শন ছড়িয়ে থাকতে দেখা যেত। কিন্তু এখন একে একে সব উধাও হয়ে যাচ্ছে।”

টুসামা গ্রামেও একটি দেউল ছিল। পর্যটকরা এক দশক আগেও দেউলটিকে খাড়া অবস্থায় দেখেছেন। বর্তমানে ওই দেউল মাটির সাথে মিশে গিয়েছে। পাথরের খণ্ডগুলি এদিক-ওদিকে অবহেলায় ছড়িয়ে রয়েছে। বাসিন্দারা সেই সব পাথরের টুকরো তুলে নিয়ে গিয়ে ঘর-গেরস্থালীর কাজে ব্যবহার করছেন। ইতিহাস নিয়ে যাঁরা তথ্যানুসন্ধান করেন তাঁদের মতে, পুঞ্চা থানা এলাকায় ২৩তম তীর্থঙ্কর পার্শ্বনাথ এবং শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীরের মূর্তি বেশি আছে। পাকবিড়রায় কালো পাথরের প্রায় ছ’ফুট লম্বা একটি দিগম্বর মূর্তি রয়েছে। আগে মূর্তির মাথায় পাথরের ছাদ ছিল। এক দশক আগে সংস্কার করা হবে বলে ওই ছাদ ভেঙে ফেলা হয়। কিন্তু নতুন ছাদ আর হয়নি। এখন খোলা আকাশের নীচেই মূর্তিটি পড়ে রয়েছে। স্থানীয়রা অন্যান্য মূর্তিগুলিকে ভৈরব ঠাকুর হিসেবে পুজো করেন। সিন্দুরের প্রলেপে মূর্তির কিছু অংশ ক্ষয় পাচ্ছে। কার্যত নষ্ট হতে বসেছে এই সব পুরা নির্দশন। প্রত্নসামগ্রী সংরক্ষণের জন্য দেউল চত্বরে হলঘর তৈরি করা হয়েছিল। সেখানে কিছু পুরাকীর্তি এখনও রয়েছে। কিন্তু সেই হলঘরের অবস্থাও ভাল নয়। বাসিন্দারা জানান, জানলা-দরজা একে একে খুলে পড়ায় ওই হলঘরের নিরাপত্তা বলে কিছু নেই। অনেক পুরা শিল্পের নিদর্শন ওখান থেকেও বেহাত হয়েছে বলে কিছু বাসিন্দার অভিযোগ।

পুঞ্চার বিডিও সুপ্রতীক সিংহ বলেন, “সরকার পাকবিড়রাকে পর্যটন কেন্দ্র হিসাবে গড়ে তুলতে ৭৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করেছে।” তাঁর দাবি, ৯০ ভাগ কাজই হয়ে গিয়েছে। ওই জৈন মূর্তির মাথায় ছাউনি তৈরি এবং আরও কিছু কাজ বাকি আছে। এ ছাড়াও সম্প্রতি পর্যটন কেন্দ্রের জন্য আরও ৮৯ লক্ষ টাকা মঞ্জুর হয়েছে। পূর্ত দফতর ওই কাজ করবে। একটি সংগ্রহশালা, পর্যটকদের থাকার ব্যবস্থা, আলো, পানীয় জল এবং মূল রাস্তা থেকে পাকবিড়রা পর্যন্ত পাকা রাস্তা তৈরি করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দিয়েছেন। বাসিন্দাদের দাবি, এই সব পরিকল্পনা যত দ্রুত কার্যকর করে পুরা সামগ্রী রক্ষা করা যাবে ততই ভাল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন