বিপদের যান। বিনা নজরদারিতেই পথে অবাধে চলছে এই সব গাড়ি। —ফাইল চিত্র
মোটর সাইকেলের বাতিল ইঞ্জিন কিংবা জল তোলার শ্যালো মেশিন তিন চাকার ভ্যানে লাগিয়ে স্থানীয় ভাবে তৈরি হয় ওই গাড়ি। পড়ে না মোটর ভেহিক্যাল আইনের আওতায়। দুর্ঘটনা ঘটলে মেলে না কোনও ক্ষতিপূরণও। অথচ পঞ্চায়েত স্তরে সহজ শর্তে ছাড়পত্র নিয়ে উঠে পড়ছে জাতীয় সড়কেও। প্রশাসনের একপ্রকার নিয়ন্ত্রণে না থাকা সেই মোটর চালিত ভ্যানেরই দুর্ঘটনা প্রাণ কেড়ে নিল এক শিশুর। জখম হলেন চালক-সহ সাত জনও। জখমদের মধ্যে ছ’বছরের এক শিশুও রয়েছে। আশঙ্কাজনক অবস্থায় যাকে বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে।
শুক্রবার দুপুরে রানিগঞ্জ–মোরগ্রাম জাতীয় সড়কে রামপুরহাট হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকায় দুর্ঘটনাটি ঘটেছে। একটি সরকারি বাসের সঙ্গে ধাক্কায় ভ্যানের যাত্রীরা রাস্তায় পড়ে যান। মাথায় গুরুতর আঘাত লেগে রাজু শেখ (৭) নামে এক বালকের মৃত্যু হয়। পুলিশ জানায়, মৃতের বাড়ি মুর্শিদাবাদের খড়গ্রাম থানার উত্তর গোপীনাথপুর গ্রামে। দুর্ঘটনায় আহত ভ্যানের চালক সাহেব শেখের বাড়ি মাড়গ্রামের মল্লিকপুর গ্রামে। আহত বাকিরা উত্তর গোপীনাথপুরের বাসিন্দা। প্রত্যেকেই রামপুরহাট মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। ওই ঘটনার পরেই প্রশ্ন উঠেছে পুলিশ ও প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে। অভিযোগ, ওই ধরনের যান জাতীয় সড়কের উপর চলাচল করা নিষিদ্ধ হওয়া সত্ত্বেও তা ঠেকাতে কোনও পদক্ষেপ করে না পুলিশ-প্রশাসন। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় নজরদারি থাকলে ওই শিশুকে এ দিন বেঘোরে প্রাণ দিতে হতো না বলেই এলাকাবাসীর দাবি।
এ দিকে, এলাকার মানুষের প্রশ্ন, যে দুর্ঘটনাটি ঘটল তাতে একটি শিশুর প্রাণ গেল। পরিবহণ দফতর স্বীকৃত যান না হওয়ায় ওই শিশুর পরিবার কোনও আর্থিক ক্ষতিপূরণও পাবে না। তার পরেও পুলিশ-প্রশাসন থেকে নাগরিক— কেউ-ই সচেতন হচ্ছেন না। ওই ধরন যান নিয়ন্ত্রণে কেন ব্যবস্থা নেওয়া হয় না? প্রশ্নের জবাবে মহকুমা প্রশাসন এবং ট্রাফিক পুলিশের ঘাড়েই দায় ঠেলেছেন জেলা পরিবহণ আধিকারিক বীরবিক্রম সিংহ। তাঁর বক্তব্য, ‘‘ওই ধরনের যান মোটর ভেহিক্যাল আইনের আওতায় পড়ে না। ভ্যানগুলি নিয়ন্ত্রণের বিষয়টি মহকুমা প্রশাসন এবং এলাকার ট্রাফিক পুলিশের দেখার কথা।’’ জাতীয় সড়কের উপরে যে মোটরচালিত ভ্যান চলাচল করার কথা নয়, তা মেনে নিয়েছেন এসডিও (রামপুরহাট) সুপ্রিয় দাসও। তিনি মেনেই নিয়েছেন, ‘‘নিষিদ্ধ সত্ত্বেও রামপুরহাট হাসপাতাল পাড়া সংলগ্ন এলাকা বা জাতীয় সড়কের ধারে বেশ কিছু যন্ত্র চালিত ভ্যান চলাচল করে। ওই গাড়িগুলির বিরুদ্ধে মাঝে মাঝে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কিন্তু তার পরেও ভ্যান চলাচল কমানো যায়নি।’’ তবে এ দিনের ঘটনার কথা শুনে এসডিপিও এবং ওসি ট্রাফিকের সঙ্গে কথা বলে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস তিনি দিয়েছেন। একই আশ্বাস দিয়েছেন শহরের ট্রাফিক অফিসার ইনচার্জ রণজিৎ বাউড়িও।
পুলিশ-প্রশাসন আশ্বাস দিলেও বাস্তব কিন্তু অন্য কথা বলছে। এ দিন দুর্ঘটনার ঘণ্টাখানেক পরেও দেখা গেল বিকট আওয়াজ করে কালো ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে ১০-২০ জন যাত্রী নিয়ে হাসপাতাল সংলগ্ন এলাকা থেকে জাতীয় সড়ক দিয়ে ওই সব যন্ত্র চালিত ভ্যান চলাচল করছে। কারও কোনও হেলদোল নেই। হাসপাতালের বেডে শুয়ে এ দিনের দুর্ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী, ভ্যানের যাত্রী রাহেল শেখ নামে এক কিশোর বলে, ‘‘স্থানীয় মল্লিকপুরে বিয়ে বাড়ির নেমন্তন্ন খেয়ে উত্তর গোপীনাথপুর গ্রামে যাওয়ার জন্য ভ্যানে চেপে রামপুরহাট বাসস্ট্যান্ডে আসছিলাম। পথে হাসপাতালের কাছে বিপরীত দিক থেকে আসা একটি সরকারি বাস আমাদের ভ্যানের হাতলে ধাক্কা মেরে চলে যায়।’’ ধাক্কা লাগতেই ভ্যানে থাকা সতেরো জন যাত্রীর কেউ জাতীয় সড়কের উপরে, কেউবা জাতীয় সড়কের ধারে পড়ে যান। এরই মধ্যে পড়ে গিয়ে মাথায় গুরুতর আঘাত লাগে রাজুর। ঘটনাস্থলেই তার মৃত্যু হয়। দুর্ঘটনাগ্রস্ত যন্ত্রচালিত ভ্যানের যাত্রী ছিলেন রাজুর বাবা জমির শেখও। পেশায় রাজমিস্ত্রি জমির শুধু বললেন, ‘‘আমার সব শেষ হয়ে গেল!’’