দুই ছবি। বৃহস্পতিবার রঘুনাথপুরের ভোটগণনা কেন্দ্রে তখন ব্যস্ততা তুঙ্গে। শুক্রবার বিষ্ণুপুরের গণনাকেন্দ্র যেন ভাঙা হাট। ছবি: প্রদীপ মাহাতো ও শুভ্র মিত্র।
বসন্তপুর গ্রামের মোড়ে রয়েছে মূর্তিটি। বেদীতে লেখা, শহিদ জাগরণচন্দ্র সোরেন। তার নীচে জন্ম এবং মৃত্যুর তারিখ। প্রতি বছর এই দিনটিতে স্বামীর মূর্তিতে মালা দিয়ে যান পানসুরিদেবী। রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় গ্রামের পুরনো বাসিন্দাদের মনে পড়ে যায়, আরও একটা বছর পার হয়ে গেল। ২০ মে ১৯৮৪। খুন হয়েছিলেন কংগ্রেস নেতা জাগরণ সোরেন। অভিযোগ উঠেছিল স্থানীয় সিপিএম নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
নিহত সেই নেতার ছেলে রাজীব এখন এই এলাকার (বান্দোয়ান কেন্দ্র) বিধায়ক। বৃহস্পতিবার ভোটের ফল বেরোনোর পরে দেখা গিয়েছে, পুরুলিয়ায় একটিও আসন পায়নি সিপিএম। আর জেলার প্রার্থীদের মধ্যে সব থেকে বেশি ব্যবধানে জয়ী হয়েছেন রাজীব। গত বিধানসভা নির্বাচনেও এই কেন্দ্রে দুর্গ ধরে রাখতে পেরেছিল বামেরা। কিন্তু এ বারে এই তরুণ প্রার্থী তা জয় করে নিলেন। গত বারের বিধায়ক সিপিএমের সুশান্ত বেসরাকে তিনি ২০ হাজারেরও বেশি ভোটে পরাজিত করেছেন।
ফলে, বোরো থানার বসন্তপুর গ্রামটিতে এ বছর ছবিটা একে বারে অন্য রকম। শুক্রবার সেখানে গিয়ে দেখা গেল, মূর্তিটির উপরে শামিয়ানা। ফুল আর মালায় জাগরণবাবুর মুখ প্রায় ঢাকা পড়ার জোগাড়। গ্রাম, এমনকী গ্রামের বাইরে থেকেও অনেকে এসে জড়ো হয়েছেন সেখানে। বেদিতে মাথা ঠেকিয়ে স্থির হয়ে বসেছিলেন পানসুরিদেবী। অঝোরে কেঁদে চলেছিলেন। পাশ থেকে এক প্রবীণ তৃণমূল কর্মী বললেন, ‘‘৩২ বছর পরে বৃত্তটা সম্পূর্ণ হল।’’
বসন্তপুর গ্রামের বাসিন্দা জাগরণবাবু ছিলেন কংগ্রেস নেতা। পেশায় প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক। ১৯৮৪ সালের ২০ মে স্কুল থেকে ফেরার পথে প্রকাশ্য দিনের আলোয় খুন হন তিনি। রাস্তার উপর পড়েছিল তাঁর দেহ। মাথায় কাঁধে কুড়ুলের কোপ। পেটে তির বেঁধা। ৩২ বছর আগে সেই দৃশ্য দেখে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলেছিল ছোট্ট রাজীব। আট বছরের ছেলেটিকে পড়শিরা কোলে তুলে সরিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। এই সমস্ত কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল পানসুরিদেবীর। বললেন, ‘‘আজ ওঁর কথা বড্ড মনে পড়ছে। এই দিনটা যদি দেখতে পেতেন!’’
জাগরণবাবু খুন হওয়ার পরে অভিযোগের আঙুল উঠেছিল স্থানীয় সিপিএম নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে। এলাকার তৃণমূল নেতাদের দাবি, মানবাজার ২ ব্লক এলাকায় জাগরণবাবু কংগ্রেসের দক্ষ সংগঠক ছিলেন। তাই এলাকার রাশ হাতে পেতে তাঁকে খুন করা হয় বলে সেই সময় অভিযোগ উঠেছিল। রাজনীতির বাইরেও এলাকায় সুনাম ছিল জাগরণবাবুর। তাঁর মৃত্যুর পরে গ্রামের মোড়ে আবক্ষ মূর্তিটি প্রতিষ্ঠা করে স্থানীয় হাট কমিটি। তবে, এ দিন মূর্তির সামনে অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছিল বান্দোয়ান বিধানসভা তৃণমূল কমিটি।
যাঁর জন্য দিনটার তাৎপর্য এ বছর বদলে গেল, সেই রাজীব কিন্তু এ দিনের স্মরণ অনুষ্ঠানে থাকতে পারেননি। শুক্রবার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দলের সব-নির্বাচিত বিধায়কদের নিয়ে বৈঠকে বসেছিলেন। দলনেত্রীর ডাকে কলকাতায় গিয়েছিলেন রাজীব। তবে তার আগে সময় বের করে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে গিয়েছেন বাবার মূর্তির সামনে। পেশায় শিক্ষক রাজীব কর্মসূত্রে বান্দোয়ানে থাকেন। তিনি বলেন, ‘‘বৃহস্পতিবার ফল ঘোষণা হওয়ার পরে কর্মীদের সঙ্গে অনেক জায়গায় বৈঠক করতে হয়েছে। বান্দোয়ানের বাড়িতে ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। তবু তার আগে রাতে একবার বসন্তপুরে গিয়েছিলাম। বাবার মূর্তিতে মালা দিয়ে এসেছি। ওঁর আশীর্বাদ ছাড়া এ সবের কিছুই হত না।’’
রাজীব না থাকলেও তাঁর দুই দাদা চাঁদরায় এবং সিংরায় এ দিনের অনুষ্ঠানে ছিলেন। তাঁরাও পেশায় শিক্ষক। জেলার বিধায়করা ছাড়া প্রায় সমস্ত ছোটবড় তৃণমূল নেতাই হাজির ছিলেন। ছিলেন মানবাজার ২ ব্লকের তৃণমূল সভাপতি হংসেশ্বর মাহাতো এবং বান্দোয়ানের তৃণমূল ব্লক সভাপতি রঘুনাথ মাঝি। তাঁরা বলেন, ‘‘বান্দোয়ান থেকে সিপিএমকে সরাতে ৩৯ বছর সময় লেগে গেল। এই সময়ের মধ্যে আমাদের বহু কর্মী খুন হয়েছেন। গায়েব হয়েছেন। শেষ পর্যন্ত সাধারণ মানুষ জাগরণবাবুর ছেলেকে জিতিয়ে তার জবাব দিয়েছেন। আজ তাঁর আত্মা শান্তি পেল।’’
আর চোখের জল মুছে পানসুরিদেবী বলেন, ‘‘এর আগেও তো প্রতি বছর ওঁর জন্য অনুষ্ঠান হতো। কিন্তু এত ব়ড় করে হয়নি। যখন বেঁচে ছিলেন সবাই ঘিরে থাকত। আজ অনেক দিন পর এত লোকজন ওঁর জন্য জড়ো হলেন। দেখতে পেলে খুব খুশি হতেন।’’