ডিজে বক্সের দাপটে কোপাইয়ে ফিকে বাউল গান

পর্যটকদের একাংশের অভিযোগ, তার কারণ ডিজে বক্স। গোয়ালপাড়া সংলগ্ন কোপাই নদীর চার দিকে ডিজে বক্সের দাপটে কান পাতা দায়। এই অবস্থায় পর্যটকদের অনেকেই কোপাইয়ের তীরে বেশিক্ষণ সময় কাটাতে চাইছেন না।

Advertisement

দেবস্মিতা চট্টোাপাধ্যায়

শান্তিনিকেতন শেষ আপডেট: ০২ জানুয়ারি ২০১৯ ০২:১৪
Share:

উদ্দাম: সরবে বাজছে ডিজে বক্স। চড়ুইভাতির ফাঁকে নাচ যুবকদের। মঙ্গলবার কোপাইয়ের তীরে। নিজস্ব চিত্র

কোপাই নদীর তীরে বসে বাউলগান শোনা। সামনে ধীরগতিতে নদীর বয়ে চলা— শান্তিনিকেতনে পর্যটকদের কাছে তা আকর্ষণীয়। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে সেই ছবি অনেক বদলেছে।

Advertisement

পর্যটকদের একাংশের অভিযোগ, তার কারণ ডিজে বক্স। গোয়ালপাড়া সংলগ্ন কোপাই নদীর চার দিকে ডিজে বক্সের দাপটে কান পাতা দায়। এই অবস্থায় পর্যটকদের অনেকেই কোপাইয়ের তীরে বেশিক্ষণ সময় কাটাতে চাইছেন না। স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, তাতে রোজগারে টান পড়ছে বাউলশিল্পীদের। চড়ুইভাতির আনন্দে মেতে ওঠার পাশাপাশি পরিবেশের দিকও যাতে সকলে খেয়াল রাখেন, সেই দাবিও উঠছে।

ক্যালেন্ডারে পৌষ আসতেই কোপাই নদীর তীরে গোয়ালপাড়ায় চড়ুইভাতি করতে আসেন অনেকে। আশপাশের এলাকার পাশাপাশি ভিড় জমে পড়শি জেলাক মানুষেরও। পর্যটকদের অনেকের অভিযোগ, এখন চড়ুইভাতির জায়গায় ডিজে বক্সের দাপাদাপি বেড়েছে। তরুণ প্রজন্ম আনন্দে মাতোয়ারা হচ্ছেন। সমস্যায় পড়ছেন একই জায়গায় চড়ুইভাতি করতে আসা অন্য পরিবার।

Advertisement

মঙ্গলবার ছিল ইংরেজি বছরের প্রথম দিন। স্বাভাবিক ভাবেই চড়ুইভাতির মেজাজে ছিলেন আট থেকে আশি। বোলপুর ও শান্তিনিকেতন সংলগ্ন বেশ কিছু এলাকা এ দিন জমজমাট ছিল। এ দিন গোয়ালপাড়ায় গিয়ে দেখা যায়, শ’খানেকের বেশি দল চড়ুইভাতি করছে সেখানে। অনেকে নদীর পাশে জায়গা না পেয়ে বসে গিয়েছেন রাস্তার ধারের জমিতেও। জমিতে সবেমাত্র আলু চাষ করেছেন, এমন চাষিরা জমি পাহারায় ব্যস্ত। কোপাই নদীতে এই সময় জল খুব কম থাকে। নদীতেই দাঁড়িয়ে নিজস্বী তুলছেন কেউ কেউ।

কিন্তু শব্দদানবের তাণ্ডবে নষ্ট হচ্ছে শান্ত ওই পরিবেশ।

নদীর তীর ছাড়িয়ে আশপাশের কয়েকশো মিটার এলাকায় ছড়াচ্ছে সেই শব্দ। চড়ুইভাতিতে আসা দলের অর্ধেকই মেতেছেন ডিজে বক্সে। তাঁদের কেউ কেউ জানালেন, আগে স্থানীয় ভাবে এত ডিজে বক্স ভাড়া পাওয়া যেত না। তাই এত বক্স বাজত না। কিন্তু এখন আশপাশেই ডিজে বক্স ভাড়া পাওয়া যায়। তাই জাপটও বেড়েছে তার।

এ দিন চড়ুইভাতিতে আসা অনেক পরিবারের সঙ্গে ছিলেন প্রবীণেরাও। শব্দের তাণ্ডবে তাঁরা অস্বস্তিতে পড়েন। কাটোয়া থেকে চড়ুইভাতি করতে আসা এক পরিবারের প্রবীণ সদস্য জানান, দু’বছর আগে এই জায়গাতেই তাঁরা চড়ুইভাতি করতে এসেছিলেন। তখন ডিজে বক্সের এমন দাপট ছিল না। কেউ জোরে বক্স বাজালেও আপত্তি উঠলে গান বন্ধ হতো। এখন বেশিরভাগই ডিজে বক্সের গানে মেতে থাকেন। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, ‘‘পাশাপাশি দু’জন দাঁড়িয়ে। আওয়াজের ঠেলায় একে অন্যের কথাও শুনতে পাচ্ছি না। একটু নিরিবিলি হবে বলেই তো অত দূর থেকে এখানে আসা। এ ভাবে চললে আর আসা যাবে না।’’

একটু এগোতেই শোনা গেল, বক্সে বাজছে আদিবাসী গান। ওই দলের এক সদস্য জানালেন, তাঁরা দশ বছর ধরে ১ জানুয়ারি গোয়ালপাড়ায় চড়ুইভাতি করতে আসছেন। আগে মাদল নিয়ে আসতেন। মাদল বাজিয়ে গান হত। সেই তালেই সবাই মেতে উঠতেন। কিন্তু এখন সবাই ডিজে বক্স বাজায়। ওই আওয়াজে মাদলের তান শোনা যায় না। বাধ্য হয়ে তাঁরাও তা-ই বক্স বাজাচ্ছেন।

গোয়ালপাড়ার স্থানীয় বাসিন্দাদের একাংশের কথায়, ‘‘ডিজে বক্সের এমন বাড়াবাড়ি আগে ছিল না। এখন চড়ুইভাতির মরসুম এলেই বাড়ির বয়স্ক বা অসুস্থদের নিয়ে চিন্তা হয়। এই সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার।’’

কোপাইয়ের সেতুর পাশেই বসে ছিলেন এক বাউলশিল্পী। তিনি বললেন, ‘‘চার দিকে এত আওয়াজ। কোনও পর্যটক আজ বাউল গান শুনতে আসেননি। সারা দিনে আমার আয় হয়েছে ৩০ টাকা। আগে আওয়াজ বেশি হলে আমরা নিষেধ করতাম। এখন নিষেধ করার কেউ নেই। তা-ই আওয়াজও বাড়ছে।’’

এ নিয়ে রূপপুর গ্রাম পঞ্চায়েতের উপপ্রধান রণেন্দ্রনাথ সরকারের প্রতিক্রিয়া, ‘‘ওই এলাকায় লাগামছাড়া ডিজে বক্স বাজছে এমন খবর পেয়েছি। পঞ্চায়েত থেকে যতটা সম্ভব চড়ুইভাতি করতে আসা মানুষদের সচেতন করা হবে। প্রয়োজনে প্রশাসনকেও বিষয়টি জানাব।’’

এই শীতে প্রকৃতির ছোঁয়ায় সব স্তরের মানুষ আনন্দে মেতে উঠুক, কিন্তু ডিজে বক্সের আওয়াজ থেকে যেন রেহাই মেলে— এমনটাই আর্জি করছেন স্থানীয় মানুষ।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন