বিজয়া সম্মিলনীতে আপ্লুত যোগমায়ারা

নিজের বাড়িতে ভিক্ষাজীবীদের নিয়ে বিজয়া সম্মিলনীর আয়োজন করেছিলেন মনোহারীর দোকানদার, নানুর থানা পাড়ার বাসিন্দা গয়ানাথ। তবে এ বারই প্রথম নয়, গত বছর থেকেই একক প্রচেষ্টায় ওই সম্মিলনীর আয়োজন করছেন তিনি।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

নানুর শেষ আপডেট: ০৭ অক্টোবর ২০১৭ ০৬:৪০
Share:

একসঙ্গে: বিজয়া সম্মিলনীর পরে সকলে খেতে বসেছেন। নিজস্ব চিত্র

পায়ে হাতের ছোঁওয়া পেতেই নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলেন না যোগমায়া মেটে, আদর বিত্তার, অঞ্জলি থান্দাররা। এর আগে নিজের ছেলেমেয়েরা ছাড়া কেউ বড় একটা প্রণাম করেনি। পায়ে হাতের ছোঁওয়া পেতেই গয়ানাথ রুদ্র এবং তাঁর স্ত্রী আগমনী রুদ্রকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ভাসালেন তাঁরা।

Advertisement

শুধু যোগমায়া মেটেরাই নন, প্রায় শতাধিক ভিক্ষাজীবীর মুখেই শোনা গেল একই প্রতিক্রিয়া।

নিজের বাড়িতে ভিক্ষাজীবীদের নিয়ে বিজয়া সম্মিলনীর আয়োজন করেছিলেন মনোহারীর দোকানদার, নানুর থানা পাড়ার বাসিন্দা গয়ানাথ। তবে এ বারই প্রথম নয়, গত বছর থেকেই একক প্রচেষ্টায় ওই সম্মিলনীর আয়োজন করছেন তিনি। এমন আয়োজনের পিছনে এক ভিক্ষাজীবীর মর্মস্পর্শী আর্তিই তাঁকে এই আয়োজনে উদ্বুদ্ধ করে। গয়ানাথ বলছিলেন সে দিনের গল্প। সেদিনও ছিল শুক্রবার। সপ্তাহের ওই দিনতেই নানুর বাজার এলাকায় ভিক্ষাজীবীদের ভিক্ষা দেওয়ার নিয়ম। সেদিন তাঁর দোকানে স্থানীয় মোতিপুরের ৬৬ বছরের ভিক্ষাজীবী হারাধন দাস ভিক্ষা নেওয়ার পর প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘‘আচ্ছা বিজয়ার দিনটাও মানুষের বিরক্তির শিকার হতে হবে! অথচ বাড়িতে অন্য কেউ এলে কত আদর-আপ্যায়ন হয়। আমাদের কেউ কী একটা দিন ভালোবেসে মিষ্টিমুখ করাতে পারে না?’’ সে দিন ওই ভিক্ষাজীবীর প্রশ্নই নাড়িয়ে দেয় গয়ানাথবাবুকে।

Advertisement

ছোট্ট দোকানের আয়েই কোনও রকমে জোড়াতালি দিয়ে চলে গয়ানাথবাবুর দুই ছেলে এবং স্ত্রীকে নিয়ে চার সদস্যের সংসার। কিন্তু সাতপাঁচ না ভেবেই গয়ানাথবাবু পরের শুক্রবার নিজের দোকানের সামনে চেয়ার পেতে বিজয়া সম্মিলনীর আয়োজন করেছিলেন। শতাধিক ভিক্ষাজীবীকে ভরপেট টিফিনে আপ্যায়িত করেন তিনি। এবারও তার অন্যথা হয়নি। এবারে অবশ্য আয়োজন করেছেন নিজের বাড়িতেই। টিফিনের পাশাপাশি ছিল মধ্যাহ্ন ভোজে খিচুড়ি, তরকারি, টক, পায়েস, মিষ্টি আর আইসক্রীম। খাওয়া দাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে চলল গান, গল্প, আড্ডা, বিজয়ার প্রীতি সম্ভাষণ।

কীর্ণাহারের চণ্ডীচরণ মুখোপাধ্যায়কে বুকে জড়িয়ে ধরলেন বর্ধমানের কাঁদরার সমর দাস। কেতুগ্রামের খাসপুরের যোগমায়া মেটের হাত জড়িয়ে ধরলেন চন্ডীপুরের অঞ্জলি থান্দাররা। তাঁদের কথা আর ফুরোয় না। আনন্দোচ্ছল গলায় তাঁরা বলেন, ‘‘কী ভালো যে লাগছে বলে বোঝাতে পারব না। সম্মানের সঙ্গে কেউ তো খাওয়ায় না। বিনা নিমন্ত্রণে ভোজবাড়িতে কুকুরের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে হয়। সবার শেষে হতশ্রদ্ধার খাওয়া জোটে।’’

বিদায় নেওয়ার সময় কেউ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলেন না। রুদ্র দম্পতি যাওয়া আসার ভাড়া বাবদ ভোজনদক্ষিণা হিসাবে প্রত্যেকের হাতে ১১ টাকা করে তুলে দেওয়ার পাশাপাশি যখন পায়ে হাত ছুঁয়ে প্রণাম করতে শুরু করেছেন তখন সকলের চোখ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে শুধুই আনন্দাশ্রু।

কেউ করছেন মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ। কেউ বা আবার দু’জনকে জড়িয়ে ধরে কথা হারিয়ে ফেলছেন। ছবি চিত্রকর, আদর বিত্তাররা বলেন, ‘‘এতদিন পেটের তাগিদে ছোটবড়ো অনেককেই শুধু প্রণাম করে এসেছি। কিন্তু আমরাও যে কারও প্রণাম পেতে পারি তা ভাবতে পারিনি।’’

রুদ্র দম্পতি বলেন, ‘‘আমাদের অভাবের সংসারে এই আয়োজনে অভাব একটু বাড়ল ঠিকই। কিন্তু ওইসব মানুষের মুখের হাসি আমাদের অনেক শূন্যতা ভরিয়ে দিল।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন