গল্পগুজব: পঞ্চায়েত ভোটের দুপুরে নিস্তরঙ্গ আড্ডা। বোলপুরের আমডহরা গ্রামে। নিজস্ব চিত্র
একটু-আধটু এলাকা নয়, গোটা একটা মহকুমাই ভোট-চিত্রের বাইরে রইল!
পাশের দুই মহকুমা— রামপুরহাট ও সিউড়ির হাতোগোনা ক’টি আসনে ভোট হলেও বোলপুরের কোনও পঞ্চায়েতের কোনও আসনেই ভোট হয়নি এ দিন। লাভপুর থেকে নানুর, ইলামবাজারের অনেকেই বললেন, ‘‘ভোটের আঁচ পেয়েছি কেবল সংবাদমাধ্যমে আর পরিচিতদের ফোন, সোশ্যাল মিডিয়ায়। নইলে ভুলতে বসেছিলাম ১৪ মে পঞ্চায়েত নির্বাচন!’’
মহকুমার একাধিক লোকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, একটা সময় পঞ্চায়েত নির্বাচন ছিল উৎসবের মতো। নির্বাচনের দিন ঘোষণা হতেই প্রচার, পদযাত্রা, বৈঠক কত কী না হত। মাটির দেওয়ালগুলো রং হতে লাগত, প্রতীকচিহ্ন আঁকা হত। গাছে, ইলেকট্রিক স্তম্ভে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের পতাকা ঝুলত। চলত পুলিশ, আধাসেনার টহল। সেজে উঠত গ্রাম। নির্বাচনের দিনে সকাল সকাল বুথে যাওয়ার হিড়িক পড়ে যেত। অনেক সময় রান্নাও হত এক জায়গাতেই। সেখানেই সবাই খেয়ে নিতেন। নির্বাচনের ফল ঘোষণা হতেই যেন ‘অকাল বসন্ত উৎসব’ হত গ্রামে গ্রামে। সঙ্গে বিজয় মিছিল, মিষ্টি বিতরণ, বাজি ফাটানো আরও কত কী। ভোট-হীন ‘কেষ্ট-তালুকে’ উৎসবেও ভাঁটা। পঞ্চায়েতে বেশির ভাগই কৃষি, শ্রমজীবী মানুষের বাস। সোমবারও অন্য দিনের মতো সকালে উঠে যে যার কাজে বেরিয়ে পড়েছিলেন। সবচেয়ে মনখারাপ ছিল নতুন ভোটারদের। তবে কমতি ছিল না ভোট নিয়ে নানা জল্পনায়। রামপুরহাট, সিউড়ি তো বটেই রাজ্যের ভোটের ছবি কেমন? কে, কত আসন পেতে পারে, শতাংশের বাড়া-কমা কতটা, প্রধান বিরোধী দল কে— চায়ের পেয়ালায় উঠেছে তুফান। নানা মত, নানা দাবি পেরিয়ে একটা সময় ঘরমুখো হয়েছেন সকলে। এটাই ছিল সোমবারের বোলপুরের সামগ্রিক ছবি।
প্রবীণদের অনেকে জানালেন, আগের পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই মহকুমার চেনাছবিটা হারাতে শুরু করে। সে বার ইলামবাজার ব্লকের জেলা পরিষদের কেবলমাত্র একটি আসনে নির্বাচন হয়েছিল। নানুর ও বোলপুর ব্লকের কিছু কিছু গ্রাম, যেমন বাহিরি, সিঙ্গি, সনসত, সাত্তোর, কসবা, গোয়ালপাড়ার কিছু অংশে নির্বাচন হয়েছিল। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বিরোধী দলের প্রার্থীদের সঙ্গে নজরে পড়েছিল শাসকদলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব। অনেক আসনেই তাই নির্দল প্রার্থীরা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। পাঁচ বছর পেরিয়ে বোলপুর মহকুমা থেকে সে ছবিও উধাও। বিরোধী দলের কিছু নেতাও একান্তে মানছেন, যে মহকুমায় নানুর, পাড়ুইয়ের মতো এলাকা রয়েছে সেখানেও শাসকদল গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে রাশ টানতে পেরেছে। একই সঙ্গে উঠেছে মনোনয়ন-পর্বে রাস্তায় ‘উন্নয়ন’ দাঁড় করিয়ে বাধা দেওয়ার অভিযোগও। দিনের শেষে নেই নির্বাচনই।
কী বলছে রাজনৈতিক মহল?
জেলা পরিষদের সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী বলছেন, ‘‘রাজ্য সরকারের উন্নয়নের জোর আর বিরোধীদের সাংগঠনিক দুর্বলতায় বোলপুর মহকুমার কোনও আসনে ভোট হয়নি। তবে উন্নয়নে কোনও সমস্যা হবে না।’’ জেলার ভোট নিয়েও খুশি তিনি। তবে, খুশি নন জেলা পরিষদের প্রাক্তন সভাধিপতি অন্নপূর্ণা মুখোপাধ্যায়। তাঁর কথায়, ‘‘২০১৩ সালে ইলামবাজার ব্লকে জেলা পরিষদের আসনে সিপিএমের হয়ে লড়েছিলাম। এ বছর তো ইলামবাজার কেন, বোলপুর মহকুমাতেই কোনও নির্বাচন হল না!’’ আক্ষেপ তাঁর গলায়।
ভোটের দিনে পুরনো প্রশ্নটাই আবার তুলেছেন জেলা বিজেপির সহ-সভাপতি দিলীপ ঘোষ। তিনি বলছেন, ‘‘এত সংগঠন যাঁদের, এত উন্নয়ন করেছেন যাঁরা, নির্বাচনে যেতে তাঁদের এত ভয় কেন? প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সন্ত্রাসের আবহে ভোট হল। শান্ত শুধু বোলপুর। এত শান্ত যে ভোটই নেই!’’