জয়ী: শংসাপত্র নিয়ে কর্মীদের সঙ্গে গোপীনাথ। নিজস্ব চিত্র
বৃহস্পতিবারের বারবেলা থেকেই একের পর এক আসনে বিপর্যয়ের খবর আসতে শুরু করেছিল। সাতটা পঞ্চায়েতই হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার পরে কিছুটা আশা ছিল, হয়তো পঞ্চায়েত সমিতিতে মুখরক্ষা হবে। কিন্তু, তাও বিজেপির হাতে চলে যাওয়ার পরে আশঙ্কা চেপে বসে— তবে কি জেলা পরিষদের বিদায়ী সভাধিপতির জন্য পরাজয়ই অপেক্ষা করছে? গভীর রাতে এল সেই খবর, তৃণমূলের গড় হয়ে ওঠা বলরামপুরেই ৯,১৪০ ভোটে হেরে গিয়েছেন বিদায়ী সভাধিপতি সৃষ্টিধর মাহাতো। তার আগেই খবর এসেছিল তাঁর ছেলে ওই পঞ্চায়েত সমিতির বিদায়ী সভাপতি তথা বলরামপুর ব্লক তৃণমূল সভাপতি সুদীপ মাহাতোও হেরে গিয়েছেন।
এই বলরামপুর কেন্দ্র থেকেই মন্ত্রী হয়েছেন জেলা তৃণমূল সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো। এমন কেন্দ্রে তৃণমূলের কেন এই ফল, তা নিয়ে প্রশ্ন ঘুরছে রাজনৈতিক নেতা-কর্মী থেকে আমজনতার মুখে। বিরোধী শিবির অভিযোগ করছেন, পিতা-পুত্রের ‘শাসনে’র বিরুদ্ধেই আদিবাসী প্রধান ব্লকের মানুষের এই রায়।
বিজেপির জেলা সভাপতি বিদ্যাসাগর চক্রবর্তী দাবি করছেন, ‘‘জঙ্গলমহলে প্রকৃত উন্নয়ন হয়নি। যা হয়েছে, তা শাসকদলের কিছু নেতার উন্নয়ন হয়েছে। এ নিয়ে আদিবাসী মানুষের ক্ষোভ ছিলই। ভোটের কয়েকদিন আগে বীরভূম জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলকে পাশে বসিয়ে বিজেপিকে নাম না করে হুমকি দিয়ে সৃষ্টিধরবাবু নিজের কেরিয়ারের শেষ পেরেকটা পুঁতে দেন। তাঁর ঔদ্ধত্যই ভোটারদের থেকে দূরে ঠেলে দিল।’’ দলের একাংশও জানাচ্ছেন, সৃষ্টিধরবাবুর নানা বিষয় নিয়ে আলপটকা মন্তব্য বারবার তাঁকে বিতর্কের কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে। তাতে দলের কিছু লোকজনের মধ্যেও তাঁর প্রতি অসন্তোষ তৈরি হয়েছিল। ঠিকাদারদের একাংশের সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ঠতাও অনেকে ভাল ভাবে নেয়নি।
সৃষ্টিধরবাবু অবশ্য সমস্ত অভিযোগ উড়িয়ে দিয়ে বলেন, ‘‘আমি বলরামপুরের মানুষের উন্নয়নই করে দিয়েছে। তাহলে উন্নয়ন করাটা অপরাধ হয়েছে!’’ দলের ব্লক সভাপতি সুদীপ মাহাতো বলেন, ‘‘‘‘এ রকম যে ফল হতে চলেছে, আমরা তা আন্দাজ করতে পারিনি। মানুষের জন্য এত কাজ করলাম, তাও কেন এই ফল হল খতিয়ে দেখতে হবে।’
জেলা তৃণমূল সভাপতির মন্তব্য, ‘‘বলরামপুরে সৃষ্টিধরবাবুর ব্যক্তিগত কিছু বিষয় ফলের ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে। তা ছাড়া ওই এলাকা ঝাড়খণ্ড সীমানা ঘেঁষা হওয়ায় বিজেপি এখানে বাইরে থেকে লোকজন এনে হুমকি দিয়ে ভোট করিয়েছে। তবে মুখ্যমন্ত্রীর উন্নয়নকে সামনে রেখে আমরা হৃতজমি পুনরুদ্ধার করবই।’’
লাগাতার মাওবাদী নাশকতায় বামফ্রন্ট কোণঠাসা হয়ে পড়তেই বলরামপুর-সহ পুরুলিয়ার জঙ্গলমহলে ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনের পর থেকেই তৃণমূল প্রভাব বাড়িয়েছিল। পরে তা আরও শক্তপোক্ত হয়। কিন্তু, খোদ বিদায়ী জেলা সভাধিপতির খাস তালুকেই যে দলের জন্য এই বিপর্যয় অপেক্ষা করছিল, তা আঁচ করা যায়নি বৃহস্পতিবার সকালে লালিমতী গার্লস স্কুলের গণনাকেন্দ্রে ব্যালট বাক্স খোলার আগেও।
কিন্তু, বেলা বাড়তেই পঞ্চায়েতের ফলে তৃণমূল ধরাশায়ী হয়। বিকেলে পঞ্চায়েত সমিতির গণনা শুরু হওয়ার সময়ও তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের মধ্যে আশা ছিল, নিচুতলায় ফলের প্রভাব হয়তো পঞ্চায়েত সমিতিতে পড়বে না। কিন্তু সময় গড়াতেই জানা যায়, ২০টি আসনের ১৮টিই বিজেপি কেড়ে নিয়েছে। ততক্ষণে গণনাকেন্দ্রের বেশ কিছু টেবিল থেকে তৃণমূলের এজেন্টরা বেরিয়ে গিয়েছেন। যার জেরে জেলা পরিষদের গণনা শুরু থমকে যায়। বিজেপি অভিযোগ তোলে, কারচুপি করার জন্য গণনায় দেরি করা হচ্ছে। শেষে গণনাকেন্দ্রের বাইরে বিরাট পুলিশ বাহিনী ব্যারিকেড তৈরি করে । তৃণমূলের এজেন্টদের ফিরিয়ে এনে গণনা শুরু হয়।
কয়েক রাউন্ড গণনা হতেই দেখা যায়, বলরামপুরে ইন্দ্রপতন হচ্ছে। রাত গড়াতেই স্পষ্ট হয়ে যায়, সৃষ্টিধরবাবুকে হারিয়ে দিয়েছেন বিজেপি প্রার্থী গোপীনাথ গোস্বামী।
রাতের আঁধারে গণনাকেন্দ্রের বাইরে তখন উড়ছে গেরুয়া পতাকা, গেরুয়া আবির।