নদীর ধারে বাস, তাই ভাবনা বারো মাস

সালটা ঠিকঠাক মনে পড়ে না। তবে, ছোটবেলার কথাটা মনে পড়ছিল। এক দিন আমিও বাবার কাঁধে চেপেই গ্রামের একটি পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এই অভিজ্ঞতা আমাদের গ্রামের অনেকেরই রয়েছে। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র ২০০ ফুট দূরে কুঁয়ে নদী। এমনিতেই বন্যাপ্রবণ এলাকা আমাদের। তার উপর কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে শনিবার সকাল থেকেই রীতিমতো ফুঁসছিল নদী।

Advertisement

বিকাশ গড়াই (‌গোকুলবাটি)

লাভপুর, বীরভূম শেষ আপডেট: ০২ অগস্ট ২০১৫ ১৭:৫০
Share:

ছবি: সোমনাথ মুস্তাফি।

সালটা ঠিকঠাক মনে পড়ে না। তবে, ছোটবেলার কথাটা মনে পড়ছিল। এক দিন আমিও বাবার কাঁধে চেপেই গ্রামের একটি পাকা বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম। এই অভিজ্ঞতা আমাদের গ্রামের অনেকেরই রয়েছে। আমাদের বাড়ি থেকে মাত্র ২০০ ফুট দূরে কুঁয়ে নদী। এমনিতেই বন্যাপ্রবণ এলাকা আমাদের। তার উপর কয়েক দিনের টানা বৃষ্টিতে শনিবার সকাল থেকেই রীতিমতো ফুঁসছিল নদী। গতিক খুব একটা সুবিধার লাগছিল না। মন কেমন যেন একটা কু গাইছিল। দুপুরে পর থেকেই মাঠ ভাসি জল ঢুকতে শুরু করেছিল গ্রামে। নদী ফুলে ফেঁপে গ্রামে ঢোকার জন্য যেন আছড়ে পড়ছিল বাঁধে। সবে তখন দুপুরের খাওয়া শেষ হয়েছে। স্ত্রীকে বললাম, ‘‘রাতের জন্য করে রাখা খাবার-সহ সব কিছু বাঁধা-ছাঁদা করে ফেলো।’’ তার মধ্যেই শুনতে পেলাম প্রবল কলরব। বুঝতে বাকি রইল না গ্রামের কাছেই বাঁধ ভেঙে ধেয়ে আসছে নদী। হাতের সামনে যা পেলাম, তাই নিয়েই বৃদ্ধ বাবা–মা, স্ত্রী, মেয়ে এবং ছেলে বিপ্লবকে কাঁধে নিয়ে পা রাখলাম স্কুলের পথে। আসার সময় আমার ৭০ বছরের বাবা কেমন যেন অবাক চোখে চেয়েছিলেন। তাঁরও হয়তো মনে পড়ছিল এক দিন আমাকেও ওই ভাবে কাঁধে করে নিয়ে যাওয়ার কথা।

Advertisement

শনিবার থেকেই ১০টি পরিবার রয়েছি স্কুলের। তিন দিন খাবারের ব্যবস্থা করেছিল প্রশাসন। একসঙ্গে থাকা, খাওয়া-দাওয়ার সুবাদে ১০টি পরিবার যেন একান্নবর্তী হয়ে পড়েছি। তা ছাড়া সবার সমস্যাও এক। সবাই রাত জেগে কে কী আনতে পেরেছি, কার বাড়িতে কী পড়ে রয়েছে, তাই নিয়ে আলোচনা করে কাটিয়েছি। এখন সবার নিজের বাড়িতে ফেরার চিন্তা। সবার ঘরই ভেঙে পড়েছে। স্কুলে থাকতেই খবর পেয়েছি আমার বাড়ির অর্ধেক ভেঙে পড়েছে। মনে হতে পারে যেন আমার ক্ষতি অর্ধেক হয়েছে। কিন্তু, যা হয়েছে তা হল গোদের উপর বিষফোঁড়া। কারণ, ওই বাড়ি মেরামত করেও কোনও ভাবেই বাসযোগ্য করে তোলা যাবে না। মাঝখান থেকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলতে অনর্থক খরচ করতে হবে। তাই নিজের ভাগ্যকেই দোষ দিচ্ছি আর ভগবানকে বলছি, ‘‘আমি কী এমন অপরাধ করেছি যে ভাঙলেই যখন তখন অন্যদের মতো পুরোপুরি ভাঙলে না কেন। আমার তো নতুন করে বাড়ি করারও সামর্থ্য নেই।’’ বিঘে দু’য়েক জমি চাষ করে দুই ছেলেমেয়ের লেখাপড়া এবং ছ’ সদস্যের সংসার কোনও রকমে জোড়াতালি দিয়ে চলে। এ বার সেই আশাও নেই। ৩০০০ টাকা খরচ করে বীজতলা এবং জমি তৈরি করেছিলাম। সব এখন জলের তলায়। মেয়ের বিয়ের চিন্তাও রয়েছে। জানি না কী করে কী হবে।

নদী বাঁধ ভেঙে গ্রামে জল ঢোকাকে আমরা বলি বানপড়া। বানপড়া আমাদের জীবনে বাৎসরিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু বর্ষার মরসুমেই নয়, মাঝে মধ্যেই নদীতে বান পড়ে। তাই নদীতে জল বাড়লে আর আমরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ি না। কারণ নদীর মর্জিতেই আমাদের জীবন বাঁধা। আমরা জেনেই গিয়েছি, নদীর ধারে বাস। তাই আমাদের ভাবনা বারো মাস।

Advertisement

এই সংক্রান্ত আরও খবর...

লম্ফ জ্বালিয়ে রাত কাটাচ্ছি ত্রাণ শিবিরে

অসুস্থ স্বামীকে পাঁজাকোলা করে তুলে ঘর ছাড়তে হল

ঘরে চাল নেই, ত্রাণের লাইনে লক্ষ্মীদেবীরা

ঠাঁই নেই ত্রাণ শিবিরে, আশ্রয় রেল স্টেশনে

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন