কড়াকড়ির ঠেলায়
১২টা বেজে ২০ মিনিট। মানবাজার-পুরুলিয়া রাস্তার ধারে একটি পেট্রোল পাম্পে মোটরবাইক নিয়ে এসে কাকুতি মিনতি করছিলেন মানবাজার থানার কেলারডি গ্রামের ব্যবসায়ী সুনীল মণ্ডল। বলছিলেন, ‘‘আজকে তেলটা দিয়ে দিন। একেবারে হেলমেট কিনে বাড়ি ফিরব।’’ কিন্তু কিছুতেই চিঁড়ে ভিজল না। পাম্পের কর্মীরা সাফ জানালেন, বিনা হেলমেটে এক ফোঁটা তেলও মিলবে না। অবশেষে, আধঘণ্টা পরে হেলমেট কিনেই পাম্পে ঢুকলেন সুনীলবাবু। বললেন, ‘‘দামটা একটু বেশি নিল বটে, তবে ভালই হল। অনেক দিন ধরে হেলমেট কিনব কিনব করছিলাম। আপনারা জেদ করায় হয়ে গেল।’’
তেলের জন্য ধার
হেলমেট পরে তেল নিতে গেলেও ঝক্কি! মানবাজারের পেট্রোল পাম্প থেকে তেল নিতে বেরোতেই হেলমেট পরা মোটরবাইক চালকদের ছেঁকে ধরেছেন বাকিরা। চলেছে টানা অনুরোধ উপরোধ। অগত্যা অনেকেই মিনিট পাঁচেকের জন্য হেলমেট ধার দিয়েছেন। অনেকে অবশ্য পাম্প কর্মীদের সঙ্গে তর্কও জুড়েছেন। রোদচশমা পরা এক যুবককে দেখা গেল চেঁচামিচি করছেন—‘‘আমি পুরুলিয়া থেকে হেলমেট ছাড়া আসছি। রাস্তায় কোথাও আটকায়নি। আর আপনারা বলছেন তেল দেবেন না! কোন আইনে লেখা রয়েছে এ সব?’’ জবাবও মেলেনি। তেলও না। বরং ওই যুবক ফিরে যাওয়ার পরে মধ্যমগ্রামের বাসিন্দা মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নির্মল মিস্ত্রি মোটরবাইকে তেল ভরতে ভরতে বলেন, ‘‘এই কড়াকড়িটা আগেই হওয়ার দরকার ছিল।’’
আপনি আচরি ধর্ম
দুই জেলার বিভিন্ন থানায় মোটরবাইক রয়েছে। সেগুলিতে চড়ে পুলিশকর্মীরা এলাকায় টহল দেন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই হেলমেটের বালাই থাকে না। পুলিশ সূত্রের খবর, অনেক থানাতেই যতগুলি মোটরবাইক রয়েছে, তত হেলমেটই নেই। ঠেকায় পড়ে নতুন হেলমেট কিনতে হয়েছে পুরুলিয়ার একটি থানাকে। ওই থানার এক পুলিশকর্মী বলেন, ‘‘আপনি আচরি ধর্ম...! নইলে কোন মুখে জরিমানা করব!’’ বাঁকুড়া শহরের পথে হেলমেট ছাড়া মোটরবাইকে সওয়ার হতে দেখা গেল বেশ কিছু পুলিশকর্মীকে। পুলিশ কি তবে নিয়মের বাইরে? মুচকি হেসে জেলা পুলিশ সুপার নীলকান্ত সুধীর কুমার বলেন, “সবার জন্য এক নিয়ম। সমস্ত থানাকেই সতর্ক করা হচ্ছে।”
বোতলে দিন
পুরুলিয়া শহরের একটি পেট্রল পাম্প। মোটরবাইক নিয়ে এক যুবক ঢুকলেন তেল নিতে। মাথায় হেলমেট নেই দেখে ফিরিয়ে দিচ্ছিলেন কর্মীরা। চট করে ডিকি খুলে একটা বোতল বের করে বললেন, ‘‘ঠিক আছে! হেলমেট নেই বলে না হয় মোটরবাইকে দিলেন না। বোতলে দিলে তো আর আইনে আটকাবে না?’’ হেসে ফেলে পাম্প কর্মী বললেন, ‘‘ও সব হবে না দাদা! হেলমেটটা পরেই আসুন না।’’ বোতল আর মোটরবাইক নিয়ে গজগজ করতে করতে বেরিয়ে গেলেন যুবক।
যাত্রীদেরও একইরকম সচেতনতার অভাব।
বিষ্ণুপুরে নিয়ম ভেঙে মোটরবাইকে আরোহী চারজন।
ভুলের মাসুল
রাঁচি রোড এবং পুরুলিয়া-বাঁকুড়া (৬০-এ) জাতীয় সড়কের মোড়ে নাকা চেকিং করছিলেন পুরুলিয়া সদর থানার পুলিশ কর্মীরা। মাথায় হেলমেট না থাকায় আটকে পড়লেন অনেকে। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন এল, ‘‘হেলমেট কোথায়?’’ কাচুমাচু হয়ে এক জন উত্তর দিলেন, ‘‘তাড়াতাড়ি বেরোতে গিয়ে ভুলে গিয়েছি।’’ সটান জরিমানা।
ভিন রাজ্যের আইন
ঝাড়খণ্ডের চাষ এলাকা থেকে মোটরবাইক চালিয়ে পুরুলিয়া শহরে কাজে এসেছিলেন জয়প্রকাশ শর্মা। ফেরার পথে ঢুকেছিলেন রাঁচি রোডের একটি পেট্রল পাম্পে। মাথায় হেলমেট নেই। তা দেখে তেল দিতে নারাজ পাম্পকর্মী জানালেন, এ রাজ্যে এখন নতুন নিয়ম চালু হয়েছে, ‘নো হেলমেট, নো পেট্রোল’। প্রথমে তাজ্জব হয়ে গিয়েছিলেন জয়প্রকাশ। তার পরে পিছনের আসনে বসা সঙ্গীর থেকে হেলমেট চেয়ে মাথায় গলিয়ে নিলেন। ট্যাঙ্কে পেট্রোল ভরে বললেন, ‘‘ভাগ্যিস সঙ্গে ছিল। নইলে কী ভাবে ফিরতাম!’’
হাতে হেলমেট
মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশের পরের দিনই রবিবার বিষ্ণুপুরের সোনামুখী মোড়ে ঘণ্টাখানেক পুলিশ হেলমেট বিহীন মোটরবাইক চালকদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। কিন্তু তারপরের দিন থেকে যে কে সেই। শহরে হেলমেট নিয়ে পুলিশের কড়াকড়ি আর চোখে পড়েনি। বুধবার খোদ এসডিও অফিসের সামনেই শিশু-সহ চারজনকে গাদাগাদি করে মোটরবাইকে যেতে দেখা গিয়েছে। কিন্তু কারও মাথায় হেলমেট ছিল না। আবার কেউ কেউ হাতে হেলমেট ঝুলিয়ে রাখলেও মাথায় না পরেই দ্রুত গতিতে শহরের ব্যস্ত এলাকার মধ্যে দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে গিয়েছেন। মাথায় পড়ছেন না কেন? এক যুবকের জবাব, ‘‘পাগল! এই গরমে কেউ হেলমেট পরে? যদি পুলিশ চেকিং করে, সে জন্য সঙ্গে নিয়ে বেরিয়েছি। সাবধানের মার নেই।’’ যদিও বাসিন্দাদের কটাক্ষ, রক্ষকই কি আইন মানছে! বাস্তবিক অভিজ্ঞতাও তাই। এ দিনই বিষ্ণুপুরের ঝাপড়মোড়ে দুই সিভিক ভলান্টিয়ারকে হেলমেট ছাড়াই মোটরবাইকে যেতে দেখা গিয়েছে। তবে সবাই তেমনটা নন। কোনও কোনও সিভিক ভলান্টিয়ারকে হেলমেট মাথায় যেতে দেখা গিয়েছে। সচেতন নাগরিকও আছে। হেলমেটহীনদের ভিড়ের মধ্যেও কেউ কেউ পাড়ায় সব্জি কিনতে বেরোলেও হেলমেট পরতে ভুলছেন না।
আপাতত ছাড়
পুরুলিয়া জেলা পুলিশ সাইনবোর্ড লাগিয়ে জানিয়েছে, বিনা হেলমেটে তেল মিলবে না। তবে বুধবার বেশ কিছু পাম্পেই হেলমেটবিহীন আরোহীদেরও তেল পেতে দেখা গেল। একই ছবি বাঁকুড়ার বেশ কিছু পাম্পেও। ওন্দার কালীসেন এলাকার একটি পেট্রোলপাম্পের মালিক তাহির আলি বলেন, “সরকারি নির্দেশ আসেনি। মৌখিক ভাবে মানুষকে মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশ জানিয়ে দিচ্ছি।’’
তথ্য: প্রশান্ত পাল, শুভ্রপ্রকাশ মণ্ডল, সমীর দত্ত ও রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়।