জয়দেবে বাস উল্টে মৃত পাঁচ পর্যটক

চালকের ঘুমই কাল হল, দাবি যাত্রীর

টানা তিন দিন ধরে বাস চালিয়ে ক্লান্ত চালকের বারবারই চোখ বুজে আসছিল। এক বার গাছে ধাক্কা মারতে মারতে বেঁচেছিল। তারও পরে ট্রাকের মুখোমুখি চলে আসলেও শেষ মুহূর্তে ঘুরিয়ে বাস বাঁচিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, যাত্রীরা চালককে সতর্ক করার পরেও তৃতীয় বার আর শেষরক্ষা হল না।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ইলামবাজার শেষ আপডেট: ২৩ জানুয়ারি ২০১৭ ০১:০২
Share:

মৃত ভারতীদেবীর শোকস্তব্ধ পরিবার। রবিবার বোলপুর হাসপাতাল চত্বরে। নিজস্ব চিত্র।

টানা তিন দিন ধরে বাস চালিয়ে ক্লান্ত চালকের বারবারই চোখ বুজে আসছিল। এক বার গাছে ধাক্কা মারতে মারতে বেঁচেছিল। তারও পরে ট্রাকের মুখোমুখি চলে আসলেও শেষ মুহূর্তে ঘুরিয়ে বাস বাঁচিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু, যাত্রীরা চালককে সতর্ক করার পরেও তৃতীয় বার আর শেষরক্ষা হল না। হঠাৎ বাঁক নিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে রাস্তার ধারে নয়ানজুলিতে পড়ে মৃত্যু হল বাসের পাঁচ পর্যটকের। জখম হলেন ৪৫ জন। চার জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক।

Advertisement

রবিবার ভোর সাড়ে ৩টে নাগাদ ওই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছে পানাগর-দুবরাজপুর ১৪ নম্বার রাজ্য সড়কে, ইলামবাজারের জয়দেবের কাছে উত্তরকোনা ও সুনবুনির মাঝে। পুলিশ জানিয়েছে, মৃতেরা হলেন কার্তিক মিশ্র (৪৫), তাঁর স্ত্রী শান্তা মিশ্র (৩৮), মেয়ে পূজা মিশ্র (১৭), ভারতী ঘোষ (৪৭) এবং রাহুল মাহাতো (১৭)। প্রথম তিন জনের বাড়ি দুর্গাপুরের ২৩ নম্বর ওয়ার্ডের এমএমসি–ডিভিসি মোড়ে। রাহুলের বাড়ি ওই ওয়ার্ডেরই নিউ সুভাষ পল্লিতে। আর ভারতীদেবী দুর্গাপুরের ২৮ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা। একই স্কুলে পূজা দ্বাদশ এবং রাহুল একাদশ শ্রেণির পড়ুয়া। দুর্ঘটনায় আহতেরা ইলামবাজার ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র, বোলপুর মহকুমা হাসপাতাল এবং দুর্গাপুরের বিধাননগর মহকুমা হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিহতদের দেহ ময়না-তদন্তের জন্য বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। ঘটনায় বাসের খালাসি জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হলেও চালক এখনও পলাতক। ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ।

পুলিশ ও পরিবার সূত্রের খবর, মুর্শিদাবাদের হাজারদুয়ারি এবং বীরভূমের তারাপীঠ ঘুরতে শুক্রবার রাত ১০টা নাগাদ দুর্গাপুর এমএমসি–ডিভিসি মোড় থেকে ৬০ জন পর্যটককে নিয়ে ওই বাসটি রওয়ানা দিয়েছিল। ঘোরাঘুরির পরে শনিবার রাত দেড়টা নাগাদ তারাপীঠ থেকে দুর্গাপুরের উদ্দেশে ছেড়েছিল ওই বাস। এ দিন সকালে বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি আহত দুই পর্যটক দিলীপ কর্মকার এবং দিপু সিংহ বলেন, ‘‘ফেরার পথে বারবার চালকের চোখ লেগে যাচ্ছিল। কোনও মতে একটি গাছে ধাক্কা খাওয়া থেকে বাঁচা গেল। আবার কিছু ক্ষণের মধ্যেই একটি ট্রাকের সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ থেকে অল্পে বাঁচল। তখনই আমরা চালককে সতর্ক করি। তার পরেও পাঁচ-পাঁচটা প্রাণ নিমিষে চলে গেল!’’ তাঁদের দাবি, ওই আধা ঘুমন্ত অবস্থায় রাস্তার বাঁক বুঝতে ভুল করেন চালক। শেষ মুহূর্তে গাড়ির স্টিয়ারিং ঘোরাতে গিয়েই বাসটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে নয়ানজুলিতে পড়ে যায়। দুর্ঘটনার খবর স্থানীয় পুলিশ এবং দুর্গাপুর থেকে একটি বাস এসে আহতদের উদ্ধার করে। বিভিন্ন হাসপাতালে ঠাঁই হয়ে তাঁদের।

Advertisement

দুর্ঘটনাগ্রস্ত সেই বাস। নিজস্ব চিত্র।

পেশায় নিরাপত্তারক্ষী কার্তিক মিশ্র স্ত্রী ও দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন। ঘটনাস্থলেই কার্তিকবাবু, তাঁর স্ত্রী এবং মেয়ের মৃত্যু হয়। র ছেলে, বছর বারোর জয় গুরুতর আহত হয়ে বিধাননগর হাসপাতালে ভর্তি। প্রাণে বেঁচে গিয়ে বারবার ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিচ্ছিলেন ইলামবাজার ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে চিকিৎসাধীন পূজা সিংহ, তন্ময় দাস এবং রাজেন্দ্র মণ্ডলরা। তাঁদের দাবি, ‘‘বারবার বারণ করা সত্ত্বেও চালক বাসের গতি কমায়নি। উল্টে ঘুমে ঢলে পড়ছিল। তার জন্যই এত বড় মাশুল দিতে হল।’’

ঘটনা হল, শনিবার রাত সাড়ে ১১টা নাগাদ ওই একই জায়গায় টহলদার এক পুলিশ গাড়ি এবং উল্টো দিক থেকে আসা চার চাকার ছোট একটি পণ্যবাহী গাড়ির মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে। ওই দুর্ঘটনায় দুই কনস্টেবল এবং দুই সিভিক ভলান্টিয়ার আহত হন। চোট গুরুতর হওয়ায় তাঁদের মধ্যে দু’জনকে বোলপুর মহকুমা হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ওই ঘটনায় পণ্যবাহী গাড়ির চালক ও খালাসিকে আটক করেছে পুলিশ। ক’দিন আগেও ওই সড়কে এ দিনের ঘটনাস্থল প্রায় ৮ কিলোমিটার দূরে ইলামবাজার বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ব্রেক ফেল করা বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে একই পরিবারের চার সদস্য-সহ পাঁচ জন মারা গিয়েছিলেন। একই রাস্তায় পরপর বড়সড় দুর্ঘটনা ঘটনায় ক্ষোভ দেখা দিয়েছে বাসিন্দাদের মধ্যে। জেলা পুলিশের এক কর্তা অবশ্য বলছেন, ‘‘দুর্ঘটনাগুলির পিছনে চালকদের বেপরোয়া মনোভাবই দায়ী। চালকদের সতর্ক করতে আমরা এলাকায় নজরদারি বাড়িয়েছি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন