পথ দেখাচ্ছে দুবরাজপুরের ক্লাব

অনুদানের টাকায় খেলার মাঠ

লক্ষ্য ছিল ক্লাবগুলিতে খেলার মানোন্নয়ন। অভিযোগ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটেছে তার উল্টোটা। আবার এমনও দেখা গিয়েছে সরাসরি রাজনৈতিক দলের হয়ে ভোট প্রচারে নেমেছে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাব।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

দুবরাজপুর শেষ আপডেট: ১০ মে ২০১৬ ০২:২৯
Share:

শিমূলডিহি গ্রামে এই জমি কিনেই তৈরি করা হচ্ছে খেলার মাঠ। —নিজস্ব চিত্র

লক্ষ্য ছিল ক্লাবগুলিতে খেলার মানোন্নয়ন। অভিযোগ, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ঘটেছে তার উল্টোটা। আবার এমনও দেখা গিয়েছে সরাসরি রাজনৈতিক দলের হয়ে ভোট প্রচারে নেমেছে সরকারি অনুদানপ্রাপ্ত ক্লাব। ওই সব বিতর্কিত পথে না হেঁটে সবাইকে চমকে দিয়েছে দুবরাজপুরের একটি ক্লাব। সরকারি অনুদানের টাকায় জমি কিনে তারা নেমেছে গ্রামের ছেলেমেয়েদের জন্য খেলার মাঠ তৈরি করতে।

Advertisement

অথচ দৌড় বা ফুটবল, ক্রিকেট, ভলিবল, কবাডির অনুশীলনই হোক বা সকাল-বিকাল প্রাতঃভ্রমণ কিংবা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান— সব কিছুর জন্যই সবার আগে চাই একটি খোলা মাঠ। আর সেই মাঠটিই ছিল না দুবরাজপুরের শিমূলডিহি গ্রামের। এলাকাবাসীর দীর্ঘ দিনের সেই আক্ষেপ ঘুচোতেই উদ্যোগী হয়েছে স্থানীয় ক্লাব শিমূলডিহি যুব সঙ্ঘ। সম্প্রতি সরকারি অনুদান বাবদ ২ লক্ষ টাকা পাওয়ার পরে কাঙ্খিত সেই মাঠ তৈরিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে ক্লাব। গ্রামের কাছেই একফসলি চার বিঘা কৃষিজমি কিনে তৈরি হচ্ছে খেলার মাঠ। নিজেদের স্বপ্ন সফল করার তাগিদে ক্লাব সদস্যদের পাশে দাঁড়িয়েছে গোটা গ্রাম।

ঘটনা হল, ২০১২ সাল থেকে গত জানুয়ারি পর্যন্ত সব মিলিয়ে ক্লাব অনুদানে তৃণমূল সরকার ২২৪ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা খরচ করেছে। খেলার উন্নয়নের নামে শুরু হওয়া এই অনুদান ব্যবস্থা নিয়ে কম সমালোচনা হয়নি। ভোটবাক্সের দিকে তাকিয়ে ক্লাবগুলিকে ‘হাতে’ রাখার কৌশল নিয়েছে শাসকদল, এই অভিযোগে বারবার সরব হয়েছে বিরোধী দলগুলি। তার পিছনে কিছু কারণও রয়েছে। অনুদান পাওয়া ক্লাবগুলির একাংশের বিরুদ্ধে কখনও জুয়ার আসর বাসানো, কোথাও বা তাস-ক্যারাম খেলা নিয়ে ওই টাকা নয়ছয় করার অভিযোগও রয়েছে। কিন্তু অনুদানে পাওয়া টাকা সঠিক পথে খরচ করে খেলাধুলা বা অন্য পরিকাঠামোগত উন্নয়ন ঘটানোর মত ব্যতিক্রমী ঘটনাও ঘটিয়েছে কিছু ক্লাব। সেই দলেই পড়ে দুবরাজপুরের লোবার শিমূলডিহি গ্রামের এই ক্লাব।

Advertisement

৬২ বছর আগে তৈরি হওয়া বর্তমানে ৬২ সদস্যের ওই ক্লাব মাস কয়েক আগেই বোলপুরের বিধায়ক চন্দ্রনাথ সিংহের সুপারিশে সরকারি অনুদানের জন্য নির্বাচিত হয়েছিল। তখন থেকেই টাকা খরচের রূপরেখা তৈরি হয়েছে। ক্লাবের সম্পাদক শেখ রবিউল ইসলাম, ক্রীড়া সম্পাদক মোজাম্মেল মণ্ডলরা বলছেন, ‘‘কিছু ক্লাব অনুদান পেতেই টাকাপয়সা ভাগ-বাটোয়ারা করে নিয়েছে, এমন খবর আমরাও পেয়েছি। কিন্তু আমাদের কাছে ওই টাকা স্বপ্নপূরণের সিঁড়ি বলা যেতে পারে। কোনও ভাবেই যেন তা বাজে খরচ না হয়, প্রথম থেকেই আমরা সচেষ্ট রয়েছি।’’

ক্লাব সূত্রে জানা গিয়েছে, বহু আগে থেকেই গ্রামের বাসিন্দাদের খেলাধুলার প্রতি ঝোঁক রয়েছে। ফুটবল ও কাবাডিতে গ্রামের একটা সুনামও আছে। অন্তত দশ জন এমন তরুণ পাওয়া যাবে, যাঁরা বিভিন্ন স্কুলের হয়ে দৌড়-শর্টপার্ট-ম্যারাথন ইত্যাদি বিভাগে জেলার সেরা হয়েছেন। কিন্তু, আক্ষেপের বিষয় ছিল গ্রামে খেলার মাঠ না থাকা। শুধু ওই গ্রামই নয়, পাশের মেটেগ্রাম, ঝিরুল, গোপালপুর-সহ আশপাশের অন্তত পাঁচ-ছ’টি গ্রামেও কোনও খেলার মাঠ ছিল না। ‘‘আমরা নিজেরাও চার কিলোমিটার দূরে হেতমপুরে গিয়ে অনুশীলন করেছি। গ্রামের চার-পাঁচ জন যুবক পুলিশ অথবা সেনা বাহিনীতে যোগ দেওয়ার জন্য দূরের মাঠে গিয়ে অনুশীলন করতেন। সব চেয়ে আফশোস লাগত গ্রামের খুদে স্কুল পড়ুয়াদের জন্য। মাঠ না থাকায় বার্ষিক ক্রীড়ার আগে ওদের মোরাম রাস্তার উপরেই অনুশীলন করতে হতো। সেই ছবিটা পাল্টাতেই এমন ভাবনা,’’—বলছেন রবিউলরা।

তবে কেবল দু’লক্ষ টাকায় যে খেলার মাঠ তৈরি সম্পূরণ হবে না, তা জানিয়েছেন ক্লাব সদস্যেরা। তাঁরা জানান, শুধু মাত্র চার বিঘা জমির দামই দু’লক্ষ টাকার থেকে অনেক বেশি। তার উপরে সেই জমিকে উঁচু করে খেলার উপযুক্ত মাঠ তৈরি করতে কমপক্ষে ৭-৮ লক্ষ টাকার গল্প। সে কথা জেনেও অনুদানের টাকা মিলতেই মাঠ তৈরি করতে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন তাঁরা। পাশে থাকতে এই উদ্যোগকে সহানুভূতির সঙ্গে দেখছেন জমির মালিকেরা। জমির টাকা পুরো না পেলেও তাই ধৈর্য ধরতে রাজি জমিদাতা শেখ মফিজুল, অরূপ চক্রবর্তী, শেখ সালেম মণ্ডলরা।

এ দিকে, টাকা জোগাড়ের নানা কৌশলও ভেবে রখেছেন ক্লাব সদস্যেরা। প্রথমত, জমির অনেকটা মাটি তুলে সেই অংশে বক্রেশ্বর তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রের ছাই ভরাট করানোর সিদ্ধন্ত হয়েছে। এ ক্ষেত্রে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র একটা মোটা অঙ্কের টাকা দেয়। এ ছাড়া ছাইয়ের উপরের মাটি ফেলে মাঠ তৈরি হলেও মাঠের উর্বর মাটি বিক্রি করেও টাকা পাওয়ার রাস্তা খোলা থাকছে। সঙ্গে রয়েছে সামনের খরিফ মরসুমে মাঠ পাহারা দেওয়ার কাজ। সেখান থেকেও বড় অঙ্কের আয় হবে ক্লাবের। এ সবই ব্যয় করা হবে খেলার মাঠ তৈরিতে। জোরকদমে তার কাজও শুরু হয়ে গিয়েছে। তরুণদের উদ্যোগে খুশি হয়ে গ্রামের শেখ লালমহম্মদ, শেখ আনারুল, শেখ ফতেনুর, স্থানীয় প্রাথমিক স্কুলের প্রধান শিক্ষক উত্তম গড়াইরা বলছেন, ‘‘একটা কাজের কাজ হচ্ছে। সত্যিই মাঠ না থাকায় খুব অসুবিধা হতো। এ বার কাছে একটা মাঠ পেয়ে ছেলেময়েরা ভাল ভাবে খেলাধুলা করতে পারবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন