রয়েছে পড়ুয়া। নজির রয়েছে ভাল রেজাল্টেরও। সে সব স্কুলে নেই শুধু শিক্ষক!
জেলার অনেক স্কুলে তাই বছরের পর বছর ধরে উচ্চমাধ্যমিক স্তরে বিষয়ভিত্তিক ক্লাস হয় না বলে অভিযোগ। টিউশনির উপরে ভরসা করে পরীক্ষা দিতে হয় ওই সব স্কুলের পড়ুয়াদের। অভিযোগ, শিক্ষক সঙ্কটে অনেক স্কুলে বন্ধ হয়েছে পড়ুয়াদের পছন্দের বিষয়ের পঠনপাঠন। সে সবের জেরে ক্ষোভ ছড়িয়েছে।
শিক্ষা দফতর ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, জেলার অনেক স্কুলে প্রয়োজনীয় সংখ্যক শিক্ষক নেই। ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ হয়েছে সাধারণ বদলি নীতি। ২০১৪ সালে লাগু ওই নিয়ম অনুসারে একটি স্কুল থেকে বছরে দু’জন শিক্ষক বা শিক্ষিকা পরিচালন সমিতির অনুমতি সাপেক্ষে পছন্দসই স্কুলে বদলি নিয়ে চলে যাওয়ার সুযোগ পান। অনেক ক্ষেত্রেই প্রথম দিকে স্কুলের পঠনপাঠনে অসুবিধার কথা বিবেচনা করে পরিচালন সমিতি অনুমতি দিতে গড়িমসি করলেও শাসক দলের সংগঠনে যুক্ত থাকার সুবাদে বা প্রভাবশালী কাউকে ধরে শিক্ষকেরা তা আদায় করে নেন বলে অভিযোগ। বিপাকে পড়ে স্কুলটি। ওই শূন্যপদ পূরণ হয় না সহজে। অবসর জনিত কারণেও স্কুলে শূন্যপদ তৈরি হয়।
স্থানীয় সূত্রে খবর, উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পঠনপাঠন শুরুর অনুমোদন দেওয়া হয়েছে অনেক মাধ্যমিক স্কুলকে। কিন্তু সে সব স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক পড়ানোর জন্য শিক্ষক নিয়োগ করা হয়নি। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকরাই কোনও ভাবে উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশোনা করিয়ে দেন। কিন্তু বর্তমানে সমস্যা আরও প্রকট হয়েছে। কারণ অনেক স্কুলে মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকই ‘বাড়ন্ত’। সীমিত সংখ্যক শিক্ষক দিয়ে দু’দিক সামলাতে গিয়ে বিপাকে পড়ছে স্কুলগুলি।
শিক্ষকদের একাংশের বক্তব্য, এতে কার্যত দু’টি স্তরের পঠনপাঠনই ব্যাহত হচ্ছে। উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বিষয়ভিত্তিক পাঠ্যক্রমের জন্য অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের ‘পার্ট টাইমে’ নিয়োগ করে কাজ চালানো হচ্ছে। কোথাওআবার সেই সুযোগও মিলছে না। টিউশনির উপরে ভরসা করেই পড়াশোনা চালাচ্ছে পড়ুয়ারা।
স্কুল দফতর ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়া হাইস্কুলে ১ হাজার ৬৩২ জন পড়ুয়ার জন্য থাকার কথা ৪২ জন শিক্ষকের। এখন রয়েছেন ৩০ জন। ৬ জন শিক্ষাকর্মীর
মধ্যে রয়েছেন ২ জন। কয়েক বছর ধরে ওই স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বাংলা ও জীববিজ্ঞানের শিক্ষক নেই। দর্শনের শিক্ষকের পদ শূন্য ৪ বছর। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষকদের দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে বাংলা ও জীববিজ্ঞানের ক্লাস করানো হলেও দর্শনের শিক্ষক নেই স্কুলে। প্রথম দিকে মাস দুয়েক ‘পার্ট টাইম’ শিক্ষকদের দিয়ে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা হলেও পরে তা-ও বন্ধ হয়ে যায় বলে অভিযোগ। অথচ ওই স্কুলে দ্বাদশ শ্রেণির কলা বিভাগে ২১৭ জন পড়ুয়ার ১৯১ জনের পাঠ্যক্রমে দর্শন রয়েছে। এ বার একদশ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়া কলা বিভাগের ২১২ জন পড়ুয়ার মধ্যে ১৯০ জন নিয়েছে দর্শন। স্কুল সূত্রে জানা গিয়েছে, কোনও ক্লাস না হলেও দর্শনে ৯০ শতাংশ ছেলেমেয়ে ৮০ শতাংশের উপর নম্বর নিয়ে উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করে।
স্কুলের দ্বাদশ শ্রেণির অরূপ ভট্টাচার্য, সুনীতা চট্টোপাধ্যায়, একাদশ শ্রেণির অন্তরা চট্টোপাধ্যায়, প্রীতম মণ্ডল বলে— ‘ভাল নম্বর ওঠে বলে ক্লাস হয় না জেনেও পাঠ্যক্রমে টিউশনির ভরসায় দর্শন রেখেছি।’
স্কুলের পরিচালন সমিতির সভাপতি জয়ন্ত ভট্টাচার্য জানান, দর্শন পড়ানোর জন্য ‘পার্ট টাইম’ কোনও শিক্ষক তাঁরা পাননি। শিক্ষা দফতরকে জানিয়ে স্থায়ী শিক্ষকও মেলেনি। ছাত্রছাত্রীদের ভর্তির সময়েই বলে দেওয়া হয় স্কুলে দর্শনের ক্লাস হবে না, টিউশনি পড়েই পরীক্ষা দিতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের দাবির জেরেই ওই বিষয়ে ভর্তি নিতে হয়।
একই সমস্যা রয়েছে মল্লারপুরের বীরচন্দ্রপুর নিত্যানন্দ হাইস্কুলেও। সেখানে ১ হাজার ৫৭১ জন পড়ুয়ার জন্য থাকার কথা ২৬ জন শিক্ষকের। রয়েছেন ২০ জন। স্কুল সূত্রে খবর, ২০০৯ সাল থেকে ওই স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে সংস্কৃতের শিক্ষক নেই। ২০১১ সাল থেকে নেই রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক। মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষককে দিয়ে ওই স্কুলে উচ্চ মাধ্যমিকে সংস্কৃত পড়ানো হলেও, শিক্ষকের অভাবে বন্ধ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পঠনপাঠন।
তা নিয়ে পড়ুয়াদের মধ্যে ছড়িয়েছে অসন্তোষ। দ্বাদশ শ্রেণির শিল্পী দাস, সম্রাট কোনাই জানায়— সংস্কৃত, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভাল নম্বর ওঠে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানে ভর্তি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সংস্কৃতে সব ক্লাস হয় না। স্কুলের প্রধান শিক্ষক অশোক ঘোষ জানান, মাধ্যমিক স্তরের সংস্কৃতের এক শিক্ষককে দিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের পড়াশোনা সামলাতে হয়। ছাত্রছাত্রীদের সমস্যা হওয়া স্বাভাবিক। এ কথা দফতরকে জানানো হয়েছে।
একই পরিস্থিতি রামপুরহাট জে এল বিদ্যাভবনেও। স্কুলে পড়ুয়ার সংখ্যা ২ হাজার ৭০০। প্রয়োজন ৪৬ জন শিক্ষক। রয়েছেন ৩৫। ২০১৫ সাল থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে জীবনবিজ্ঞানের শিক্ষক নেই। গত ডিসেম্বর থেকে নেই দর্শনের শিক্ষক। ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক প্রকাশচন্দ্র দে জানান, পার্ট-টাইমে শিক্ষক নিয়োগ করে কোনও রকমে কাজ চালাতে হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গ শিক্ষক সমিতির জেলা সাধারণ সম্পাদক অধীরকুমার দাস জানান, শুধুমাত্র টিউশনির উপরে নির্ভর করেই অনেক স্কুলে বছরের পর বছর ধরে কাগজে কলমে বিষয়ভিত্তিক পঠনপাঠন চলছে।
জেলার ভারপ্রাপ্ত মাধ্যমিক স্কুল পরিদর্শক সংঘমিত্র মাকুড় জানান, কোনও স্কুলে শিক্ষকহীন ভাবে বিষয়ভিত্তিক পঠনপাঠন চলছে বলে খবর নেই। শিক্ষক নিয়োগের বিষয়টি দেখে স্কুল সার্ভিস কমিশন। শূন্যপদের তালিকা চেয়ে পাঠানো হয়েছে। নিয়োগের প্রক্রিয়া চলছে।