নেই বরাদ্দ, ফাঁকি গ্রামীণ-স্বাস্থ্যেই

ধুলোময় যন্ত্র, ভরসা ফার্মাসিস্টই

পাড়ুই থানার অমরপুর পঞ্চায়েতের উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র চলছে টিকাকরণ কর্মসূচি। একটি শিশুর খুব জ্বর। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্স লালমণি সাহা বুঝতে পারছেন না কি করবেন। অগত্যা হাসপাতালে ফোন।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

পাড়ুই শেষ আপডেট: ০২ মার্চ ২০১৬ ০১:২৪
Share:

এ ভাবেই ধুলো জমেছে পাড়ুইয়ের গড়গড়িয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

পাড়ুই থানার অমরপুর পঞ্চায়েতের উপ-স্বাস্থ্যকেন্দ্র চলছে টিকাকরণ কর্মসূচি। একটি শিশুর খুব জ্বর। স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নার্স লালমণি সাহা বুঝতে পারছেন না কি করবেন। অগত্যা হাসপাতালে ফোন।

Advertisement

পাড়ুইয়ে‌র বাসিন্দা শেখ সামসুদ্দিনের অশীতিপর মায়ের অবস্থা বাড়াবাড়ি। পরিস্থিতি এমন, তাতে জীবনদায়ী ইঞ্জেকশন দিতেই হবে। কিন্তু, কে দেবে?

ডাক্তার না পেয়ে যেমন অতান্তরে পড়েছেন গড়গড়িয়ার বাসিন্দা নার্গিস বিবি। তিনি প্রথম মা হতে চলেছেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা করাতে এসে প্রসব যন্ত্রণায় কাতরাছিলেন। বেহাল স্বাস্থ্য চিত্রের এমন নজির মিলল শীতের দুপুরেই। রোগীর নামের তালিকা ৫৩ ছাড়িয়েছে। তা সত্বেও, পেটে ব্যাথা, জ্বর, বমি, পেট খারাপের মতো রোগী থেকে শুরু করে প্রসূতি, শিশু ও মায়েদের লম্বা লাইন। চিকিৎসকের দেখা নেই!

Advertisement

স্বাস্থ্য পরিষেবার এমন বেহাল দশা সিউড়ির মুখ্য রাস্তার উপর গড়গড়িয়া প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের। পরিষেবা পেতে আসা এলাকার বাসিন্দাদের এমন দুর্ভোগ নিত্য দিনের ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে।

বাসিন্দাদের অভিযোগ, কোনও মতে জোড়াতালি দিয়ে চলছে ওই স্বাস্থকেন্দ্র। জেলা স্বাস্থ্য দফতর এবং স্থানীয়দের সূত্রে জানা গিয়েছে, গত তিন বছর ধরে ওই হাসপাতালে নেই কোনও চিকিৎসক। মাস খানেকের মধ্যে এক মহিলা জিডিএ কর্মী অবসর নেবেন। তিন জন সেবিকার মধ্যে এক মাসের রোটেশন পদ্ধতিতে এক জনকে সাঁইথিয়া গিয়ে কাজ করতে হয়। দুই সেবিকা এবং এক জন করে ফার্মাসিস্ট, মহিলা জিডিএ এবং সুইপারকে নিয়ে জোড়া তালি দিয়ে কোনও মতে চলছে ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র।

এমন ছবি কোনও বিশেষ একটি দিনের নয়। এমন বেহাল-ছবি গত তিন বছরের। গড়গড়িয়া বাবুপাড়ার বাসিন্দা তাপস চট্টোপাধ্যায় বলছেন, ‘‘গত তিন বছর ধরেই এমন ভাবে চলছে অমরপুর এবং পাড়ুই দুই পঞ্চায়েতের বাসিন্দাদের সার্বিক স্বাস্থ্য পরিষেবা। রোগীদের নিয়ে কার্যত নাজেহাল ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের এক মাত্র ফার্মাসিস্ট তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়। কারণ তিনিই ওই হাসপাতালে ওষুধপাতি দেন। কাটা ছেড়া সেলাই করা থেকে শুরু করে দফতরের ওষুধ, ইঞ্জেকশনের হিসেব, স্টক রেজিস্ট্রার লিখে রাখা, সবই করতে হয় তাঁকে।’’ আবার ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আওতায় থাকা চার উপ স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নানা কর্মসূচী, অভাব অভিযোগও সামলান তিনি। সহায়তার জন্য রয়েছেন মাত্র দু’ জন সেবিকা।

ঘর, শয্যা থেকে যন্ত্রপাতি— সব কিছুরই বেহাল দশা। —নিজস্ব চিত্র।

স্থানীয় বাসিন্দা কৃশানু মজুমদার, তথাগত চট্টোপাধ্যায়, সীমা ডোম, গণেশ অঙ্কুররা জানান, পাঁচের দশকে মুখ্য রাস্তার ওপর কয়েক বিঘা জমিতে গড়ে ওঠে ওই প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্র। চিকিৎসক, ফার্মাসিস্ট, সেবিকাদের আবাসন-সহ সবই ছিল। প্রথম দিকে প্রসূতি পর্যবেক্ষণ ঘর, ডেলিভারি রুম, নার্সিং রুম, ওষুধ, ইনজেকশন মজুত রাখার স্টোর-সহ যাবতীয় পরিকাঠামোতে ঠাসা ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্র দিব্যি চলে সার্বিক স্বাস্থ্য পরিষেবা। দু’দুটি বড় রেফ্রিজারেটার, ঝাঁ চকচকে হাসপাতালের ভবন-সহ শুধু বহির্বিভাগের পরিষেবা নয়, চালু হয় অন্তঃবিভাগের পরিষেবা। স্থানীয় বাসিন্দা মোহন সিংহ, নিশিথ কুমার গড়াইরা বলেন, ‘‘দশটি শয্যা বরাদ্দ ছিল। ডাক্তারবাবু থাকতেন। গর্ভবতী মহিলাদের সমস্ত রকমের পরিষেবা এখান থেকেই মিলত। এখন চিকিৎসক নেই, স্বাস্থ্য কর্মীও নেই। প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো নেই। কি করে চিকিৎসা হবে?’’

পাড়ুই এবং অমরপুর— এই দুই পঞ্চায়েতের ষাট হাজারের কিছু বেশি বাসিন্দাদের স্বাস্থ্য পরিষেবা নির্ভর করে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের উপর। ২০১৫ সালের রেকর্ড বলছে ৫৮ জন টিবি রোগীর চিকিৎসা চলছে ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। তাঁদের চিকিৎসা সংক্রান্ত নাগাড়ে ফোন আসছে, কিন্তু সব সময় সদুত্তর দিতে পারছেন না স্বাস্থ্যকর্মীরা। কেন না, তাঁরা বিশেষজ্ঞও নন। কার্যত এই ভাবেই চলছে গড়গড়িয়া প্রাথমিক স্বাস্থকেন্দ্র। ফার্মাসিস্ট তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত যে পরিষেবা দিচ্ছেন, তাতেই ভরসা করে স্থানীয়রা ভিড় করেন এখানে।

স্থানীয়রা জানান, প্রায় দু’ দশক ধরে এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে রয়েছেন তরুণবাবু। যে কয়েক জন চিকিৎসকের সঙ্গে কাজ করেছেন, তাঁদের সঙ্গে পরামর্শ করে চলছে রোগী পরিষেবা। কিন্তু বাড়াবাড়ি হলে?

‘রেফার’ করা ছাড়া উপায় থাকে না বলেই স্বাস্থ্যকেন্দ্রের দাবি। স্বাস্থ্যকেন্দ্রটি যে ধুঁকছে এবং সম্পদ নষ্ট হচ্ছে তা অস্বীকার করেননি তৃণমূলের গ্রাম কমিটির সভাপতি নিরঞ্জন মণ্ডল এবং সংশ্লিষ্ট সংসদ থেকে নির্বাচিত অমরপুর পঞ্চায়েতের উপ-প্রধান চিন্ময় মুখোপাধ্যায়। তাঁরা জানান, তিন বছরের অভিযোগ ঠিক নয়। বছর খানেক হল, দলীয় স্তরের পাশাপাশি প্রশাসনিক স্তরেও আর্জি জানানো হয়েছে। দ্রুত সমস্যা সমাধানের চেষ্টা হচ্ছে। ইতিমধ্যেই স্বাস্থ্যভবনের একটি প্রতিনিধিদল তদন্ত করে গিয়েছেন।

সাঁইথিয়া বিএমওএইচ আশিস চন্দ্র বলেন, “বিষয়টি সিএমওএইচ এবং স্বাস্থ্যভবনে জানানো হয়েছে।”

বীরভূমের জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক হিমাদ্রি আরি বলেন, “বার দু’য়েক হাসপাতাল ঘুরে দেখেছি। ফেব্রুয়ারি মাঝামাঝি সময় থেকে আশা করছি জেলায় চিকিৎসক সমস্যার সমাধান হবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন