অ্যাম্বুল্যান্স নেই কেন, প্রশ্ন দলেই

সোমবার রাতে বরাবাজারের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে সংঘর্ষে আহত তিন কর্মীকে নিয়ে পঞ্চায়েত সমিতির বিদায়ী সহ-সভাপতি প্রতুল মাহাতো ওই ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান।

Advertisement

প্রশান্ত পাল

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৮ এপ্রিল ২০১৮ ০১:৪৬
Share:

তৃণমূল কর্মীদের উপরে হামলার প্রতিবাদে বরাবাজারে মিছিল

এত দিন বিরোধীরা অভিযোগ তুলতেন। এ বার ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে সেই পরিকাঠামোর অভিযোগ তুলে চিকিৎসককে মারধরে এলাকার তৃণমূল নেতৃত্বের নাম জড়িয়ে যাওয়ায় পঞ্চায়েত ভোটের মুখে অস্বস্তিতে পড়ে গেলেন শাসকদলের অনেকেই। যদিও সোমবার রাতে বরাবাজার ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের চিকিৎসকে মারধরে যে দলের নেতা-কর্মীরাই জড়িত তা মঙ্গলবার পর্যন্ত মানতে চাননি জেলা তৃণমূল নেতৃত্ব। দলের জেলা সভাপতি শান্তিরাম মাহাতো বলেন, ‘‘চিকিৎসককে মারধর করা হয়েছে বলে আমার কাছে খবর আসেনি। তবে এ রকম হলে ঠিক নয়।’’

Advertisement

সোমবার রাতে বরাবাজারের নিশ্চিন্তপুর গ্রামে সংঘর্ষে আহত তিন কর্মীকে নিয়ে পঞ্চায়েত সমিতির বিদায়ী সহ-সভাপতি প্রতুল মাহাতো ওই ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে যান। গুরুতর আহত তৃণমূল প্রার্থী প্রতিমা মাহাতোর স্বামী মনোজ মাহাতোকে প্রাথমিক চিকিৎসা করে অন্যত্র নিয়ে যেতে বলেন চিকিৎসক বিপ্লব মণ্ডল।

কিন্তু মাতৃযানের দু’টি অ্যাম্বুল্যান্স ছাড়া সাধারণ রোগীদের নিয়ে যাওয়ার জন্য স্বাস্থ্যকেন্দ্রের নিজস্ব কোনও অ্যাম্বুল্যান্স নেই। সে কথা জানাতেই চিকিৎসকের উপরে প্রথমে প্রতুলবাবু মারধর শুরু করেন বলে অভিযোগ। পরে হাত লাগান তাঁর সঙ্গীরা। মঙ্গলবার এ নিয়ে বিপ্লববাবু থানায় প্রতুলবাবু-সহ অন্যান্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ দায়ের করেন।

Advertisement

তৃণমূল নেতা-কর্মীদের মারে এক চিকিৎসক জখম হন বলে অভিযোগ। তাঁর পাশে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকার। মঙ্গলবার।

নিগৃহীত চিকিৎসক বর্তমানে বরাবাজার ব্লক প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রেই ভর্তি রয়েছেন। এ দিন তাঁর সঙ্গে দেখা করে জেলা মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক অনিলকুমার দত্ত উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘‘পুরো ঘটনাটি বিপ্লবের কাছে শুনেছি। এ ভাবে চিকিৎসকেরা যদি মার খেতে থাকেন, তাহলে পরিষেবা দেবেন কী ভাবে? পুলিশের সঙ্গে কথা বলছি।’’ যদিও এ দিন সন্ধ্যা পর্যন্ত পুলিশ কাউকে গ্রেফতার করেনি। পুলিশ সুপার জয় বিশ্বাস জানিয়েছেন, চিকিৎসকের অভিযোগের ভিত্তিতে মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হয়েছে।

বিরোধীরা অভিযোগ তুলেছেন, শাসকদলের বিধায়ক ও সাংসদেরা এলাকার উন্নয়নের তহবিল থেকে অ্যাম্বুল্যান্স ব্লক স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে না দিয়ে নিজেদের পছন্দের ক্লাব ও সংগঠনকে দেন। এই স্বজনপোষণের ফলে আখেরে যে সাধারণ মানুষ প্রয়োজনের সময় অ্যাম্বুল্যান্স পান না, তা সোমবার রাতে তৃণমূলের নেতারাই টের পেয়েছেন। জেলার চিকিৎসকদের কেউ কেউ একই অভিযোগ তুলেছেন।

জেলা স্বাস্থ্য দফতর সূত্রে খবর, বরাবাজার স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আওতায় মোট পাঁচটি মাতৃযান অ্যাম্বুল্যান্স রয়েছে। তার দু’টি রয়েছে ব্লক সদর বরাবাজারে। অন্য তিনটি রয়েছে বেড়াদা, বামুনডিহা ও সিন্দরি প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রে। বিধি মোতাবেক এই অ্যাম্বুল্যান্সগুলি প্রসূতি ও গর্ভবতী মা এবং এক বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের হাসপাতাল বা স্বাস্থ্যকেন্দ্রে নিয়ে যাওয়াআসার জন্য পরিষেবা দেয়।

বিপ্লববাবু বলেন, ‘‘মাতৃযান ছাড়া এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অন্য কোনও অ্যাম্বুল্যান্স নেই, এ কথা জেলা স্বাস্থ্য দফতর জানে। মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিকও বিষয়টি জানেন এবং রোগী কল্যাণ সমিতির সদস্য প্রতুলবাবুরও তা অজানা নয়। তার পরেও কেন তিনি মারধর করলেন বুঝতে পারছি না।’’

বিপ্লববাবু নিজে তৃণমূলপন্থী চিকিৎসক সংগঠন প্রোগ্রেসিভ ডক্টরর্স অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য। সেই সংগঠনের জেলা সভাপতি চিরঞ্জীব মুখোপাধ্যায় বলেন, ‘‘অ্যাম্বুল্যান্স না থাকা বা পরিকাঠামো সংক্রান্ত কোনও অভিযোগ থাকলে, তা জানানোর জন্য সুনির্দিষ্ট জায়গা আছে। তা না করে অসহিষ্ণু হয়ে কেউ নিজে আইন হাতে তুলে নিয়ে চিকিৎসককে মারধর করবেন মানা যায় না। আশাকরি আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’’

পুরুলিয়ার কংগ্রেস বিধায়ক তথা রাজ্য বিধানসভার স্বাস্থ্য বিষয়ক স্থায়ী কমিটির সদস্য সুদীপ মুখোপাধ্যায়ের কটাক্ষ, ‘‘গ্রামীণ স্বাস্থ্য যে বেহাল, এ বার দেখছি শাসকদল নিজেরাই সেই অভিযোগে সরব হয়েছে। তবে যে দল প্রশাসনে থাকে, তাদের নেতাদের দায়িত্ব অনেক বেশি হওয়া উচিত। কিন্তু অযোগ্য লোককে পদে বসানো হলে যা হওয়ায় তাই হচ্ছে।’’

অস্বস্তিতে পড়েছেন বরাবাজারের বাসিন্দা তথা জেলা পরিষদের বিদায়ী সদস্যা সুমিতা সিংহ মল্লও। মারধরের কথা অস্বীকার করলেও তিনি দাবি করেন, ‘‘স্বাস্থ্যকেন্দ্রে অ্যাম্বুল্যান্স দেওয়ার জন্য আমরা বিভিন্ন জায়গায় বলেছি। পাইনি।’’

স্থানীয় বিধায়ক রাজীবলোচন সোরেন দাবি করেন, ‘‘ওই স্বাস্থ্যকেন্দ্রে কী দরকার তা জানতে চাওয়ায় একবার আমাকে অপারেশন থিয়েটার-সহ নানা বিষয় সম্পর্কে জানানো হলেও অ্যাম্বুল্যান্সের অভাবের কথা জানানো হয়নি। আগে জানলে কবেই ব্যবস্থা হয়ে যেত।’’ একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘তবে চিকিৎসককে কোনও ভাবেই মারধর করা উচিত হয়নি। এটা অন্যায়। তবে সেই সময়ে প্রতুলবাবু সেখানে ছিলেন না বলেই শুনেছি।’’

আর প্রতুলবাবু দাবি করেছেন, ‘‘মুমুর্ষু রোগীর জন্য অ্যাম্বুল্যান্স না পাওয়ায় গ্রামের কেউ হয়তো উত্তেজিত হয়ে চিকিৎসকের গায়ে হাত দিয়ে থাকতে পারেন। মঙ্গলবার চিকিৎসকের কাছে গিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছি।’’

—নিজস্ব চিত্র।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন