হেনস্থা: কোথায় চোট, দেখাচ্ছেন তোশিবানন্দ বাগ। নিজস্ব চিত্র
গাড়ির সামনে হঠাৎ এসে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল মোটরবাইক। সজোরে ব্রেক কষলেন চালকের আসনে থাকা বাঁকুড়া মেডিক্যালের শিশু চিকিৎসক তোশিবানন্দ বাগ। মোটরবাইক থেকে নেমে কলার ধরে চিকিৎসককে রাস্তায় ফেলে দিল এক যুবক। ‘আমি কে জানিস?’— বলে চলল বেপরোয়া লাথি, ঘুঁষি, থাপ্পড়। তারপরে মোটরবাইক স্টার্ট করে চম্পট দেয় তারা। সেই দৃশ্য দেখতে লোকজন জড়ো হয়ে গেলেও ওই চিকিৎসককে রক্ষা করতে এগিয়ে গেলেন না কেউ।
শুক্রবার রাত সাড়ে ন’টা নাগাদ বাঁকুড়া শহরের জনবহুল এলাকা সার্কিটহাউস মোড়ে এমন ঘটনার পরে বিভিন্ন প্রশ্ন উঠে গিয়েছে। প্রথমত, কেন সাধারণ লোকজন এগিয়ে এলেন না? দ্বিতীয়ত, ঘটনাস্থলের একশো মিটারের মধ্যেই ভৈরবস্থান বাসস্টপে পুলিশ চৌকি রয়েছে। অথচ বেশ কিছুক্ষণ ধরে এক ব্যক্তিকে সরকারি ভিভিআইপি নিবাসের সামনে রাস্তায় ফেলে মারধর করা হলো, অথচ কোনও পুলিশ কর্মীই তাঁকে বাঁচাতে এলেন না কেন? তৃতীয়ত, মারধরে অভিযুক্ত ওই ব্যক্তির পরিচয় বা তার মোটরবাইকের নম্বর পরে পুলিশকে জানালেন না কেন প্রত্যক্ষদর্শীরা? এই ঘটনায় বাঁকুড়া শহরের রাস্তায় সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে।
ঘটনার ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই ওই চিকিৎসক বাঁকুড়া সদর থানায় অভিযোগ দায়ের করলেও শনিবার দুপুর পর্যন্ত পুলিশ হামলাকারীর কোনও হদিসই করে উঠতে পারেনি। পুলিশ জানাচ্ছে, ওই চিকিৎসক অজ্ঞাত পরিচয় ব্যক্তি বলে হামলাকারীর উল্লেখ করেছেন। তাই শনাক্ত করতে দেরি হচ্ছে। অথচ ওই এলাকায় পুলিশের সিসি ক্যামেরা রয়েছে। সেই ছবি কি দেখা হয়েছে? এ দিন দুপুরে বাঁকুড়ার পুলিশ সুপার সুখেন্দু হীরা ঘটনাটি শুনে এলাকার সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখার নির্দেশ দেন। তাঁর প্রতিক্রিয়া, “ঘটনাটি নিয়ে আমি বিস্তারিত খোঁজ নিচ্ছি।”
ঠিক কী কারণে তোশিবানন্দবাবুর উপরে এই হামলা হল, তাও স্পষ্ট নয়। তোশিবানন্দবাবু জানান, তিনি গাড়ি চালিয়ে বাঁকুড়া মেডিক্যালে ভর্তি থাকা রোগীদের রুটিন চেকআপের জন্য যাচ্ছিলেন। পুলিশ সুপারের বাংলোর সামনে পাশাপাশি চলা দু’টি মোটরবাইককে তিনি পার হতে যান। সেই সময় মোটরবাইক দু’টি গতি বাড়িয়ে ফের তাঁর গাড়ির সামনে চলে আসে। এরপর তিনি আর পার হওয়ার চেষ্টা করেননি। তাঁর অভিযোগ, “ভৈরবস্থান বাসস্টপ পার করে সার্কিট হাউসের মোড়ে আসতেই ওই মোটরবাইকগুলির মধ্যে একটি আমার গাড়ির সামনে আড়াআড়ি দাঁড়িয়ে পড়ে। চালক এসে দরজায় টোকা দিয়ে কাচ নামাতে বলে। আমি কাচ একটু নামাতেই ওই যুবক টেনে তা ভেঙে দেয়। তারপর দরজা খুলে জামার কলার ধরে আমাকে টেনে রাস্তায় নামিয়ে মারধর শুরু করে।’’ কেন হামলা হল? তোশিবানন্দবাবু বলেন, ‘‘আমি ওই যুবককে চিনি না। মারধরের কারণও স্পষ্ট নয়।’’
তাঁর আক্ষেপ, আশপাশে অনেকে জড়ো হলেও কেউ তাঁকে বাঁচাতে আসেননি। এমনকী মারধরের সময় অভিযুক্ত যুবকের হাত থেকে আংটি পরে গেলে, তার হুকুমে এক জন তা খুঁজে তুলে দেন। লোকজনের এই ‘নির্বাক দর্শক’ হওয়া থাকা নিয়ে শহরের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষদের মধ্যে নিন্দার ঝড় উঠেছে। অনেকেরই মনে প্রশ্ন— ওই যুবকটি কে, যে তার ভয়ে সবাই চুপ করে থাকলেন? কাছেই পুলিশ চৌকি থেকেও পুলিশ কেন বেরিয়ে এল না, তা নিয়েও অনেকে তাজ্জব।
বাঁকুড়া মেডিক্যালের আরেক শিশু চিকিৎসক সুবিনয় মণ্ডলের কথায়, “এই ঘটনার পরে তো রাতে হাসপাতাল যাওয়াটাই ভয়ের হয়ে দাঁড়াচ্ছে। আমি নিজে বাঁকুড়ার বাসিন্দা। এই শহরে এমন ঘটনা ঘটেছে বলে আগে শুনিনি।” বাঁকুড়া মেডিক্যালের অধ্যক্ষ পার্থপ্রতিম প্রধানের কথায়, “রাতে হাসপাতাল আসার পথে মহিলা চিকিৎসকদের উদ্দেশ্যে নানা অশালীন মন্তব্য উড়ে আসে। তবে এই ঘটনা তো সব কিছু অতিক্রম করে গেল! পুলিশের উচিত দোষী ব্যক্তিকে শনাক্ত করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়া।” হাসপাতালের পথে পুলিশি নিরাপত্তা বাড়ানোরও দাবি তুলেছেন তিনি।