কয়েনে জেরবার জয়দেবের ভিখারিরাও

জয়দেব-কেন্দুলির তিন দিনের মেলায় পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন পুণ্যার্থীরা। এমনকি বিদেশের পর্যটকেরাও ভিড় করেন বাউলের টানে।

Advertisement

দেবস্মিতা চট্টোপাধ্যায়

জয়দেব শেষ আপডেট: ১৭ জানুয়ারি ২০১৮ ০০:৫৪
Share:

উৎসব: ভিড় জয়দেবের মেলায়। নিজস্ব চিত্র।

গান যতটা ওঁদের টানে, তার চেয়েও বেশি ভাবায় পেট। দু’টো চাল-ডাল কিংবা সিকি-আধুলির আশায় আজও ওঁরা চলে আসেন জয়দেবের মেলায়। এ বার সেই ভিখারিরাই পড়েছেন খুচরোর গেরোয়।

Advertisement

জয়দেব-কেন্দুলির তিন দিনের মেলায় পশ্চিমবঙ্গ সহ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসেন পুণ্যার্থীরা। এমনকি বিদেশের পর্যটকেরাও ভিড় করেন বাউলের টানে। মেলায় বাউল-কীর্তনীয়ার সংখ্যা এত বেশি থাকে যে, এই মেলাকে সকলে বাউল মেলা বলেই চেনেন। প্রচুর দর্শনার্থী, সাধুসন্ত, বাউল, কীর্তনীয়াদের পাশাপাশি মেলায় আরও যাঁদের দেখতে পাওয়া যায়, তাঁরা হলেন ভিখারি। রাজ্যের বিভিন্ন অংশ থেকে হাজারখানেক ভিখারিও আসেন এই মেলায়। মকর সংক্রান্তিতে পুণ্যস্নান করে ফেরার পথে পুণ্যার্থীরা তাঁদের চাল, আলু, টাকা দিতে দিতে আসেন। অজয়ের দু’ধারে ভিড় করে বসেন তাঁরা।

কিন্তু, তাঁরা ভিক্ষা পাচ্ছেন ঠিকই, তবে পয়সার মধ্যে বেশির ভাগই রয়েছে ছোট এক টাকার কয়েন। সরকারি ভাবে ছোট এক টাকার কয়েনের ক্ষেত্রে কোনও নিষেধাজ্ঞা নেই। এমনকি কয়েন নিতে অস্বীকার করলে জরিমানা পর্যন্ত হতে পারে বলে রিজার্ভ ব্যাঙ্ক জানিয়েছে। কিন্তু, গ্রামাঞ্চল হোক বা শহরাঞ্চল, ছোট এক টাকার কয়েন নিয়ে আকচাআকচি চলছেই। ভিখারিদের মধ্যে দক্ষিণ দিনাজপুর থেকে আসা রাখহরি দাস বললেন, ‘‘পয়সা নিতে অস্বীকার করতে পারছি না। কিন্তু, এই পয়সা নিয়ে করবটা কি! কেউ তো নিতে চাইছেন না।’’

Advertisement

মুর্শিদাবাদের শেখ আব্বাসের জন্ম থেকেই একটা পা ছোট। অন্য সময় এলাকার বিভিন্ন অংশে ভিক্ষা করেন। তবে মকর সংক্রান্তিতে বিগত সাত বছর ধরেই আসেন জয়দেবে। তিনিও বললেন, ‘‘কিছু মানুষ মনে হয় এখানে পয়সা দেবেন বলেই ছোট এক টাকার কয়েন জোগাড় করে রেখেছিলেন। এখনও
পর্যন্ত যতটা খুচরো পয়সা পেয়েছি তার প্রায় ৬০ শতাংশই ছোট এক টাকা।’’ আজিমগঞ্জের উর্মিলা বাগদির ছেলে রজত বাগদি জন্মান্ধ। ছেলেকে নিয়ে প্রতিবছর আসেন জয়দেব মেলায়। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, ‘‘পেটের দায়ে এখানে প্রতি বছর আসি। কেউ পয়সা দিলে তো নিতেই হচ্ছে। এর থেকে বরং চাল দিলে ভাল হয়। ক’দিন সেই চাল ফুটিয়ে খাওয়া তো যাবে।’’

এখন মেলায় গেলেই দেখতে পাওয়া যাবে অজয়ের ধার বরাবর লম্বা লম্বা শাড়ি পড়ে রয়েছে। দূর থেকে দেখলে বিস্ময় জাগতেই পারে, এত এত শাড়ি শুকাচ্ছে কারা! তাও আবার মেলার সময়? একটু এগিয়ে গেলেই বোঝা যাবে ওই শাড়িগুলো শুকানোর জন্য ফেলা নেই। বরং স্নান করে ফেরার পথে মানুষেরা অন্নদান করেন। ওই শাড়িতেই চাল ফেলতে ফেলতে যান তাঁরা। অনেক সময় চাল শাড়িতে না পড়ে সামনের বালিতেও পড়ে যায়। মেলা শেষে সেখান থেকেও চাল কুড়িয়ে নিয়ে যান তাঁরা।

মেলার বাউল-কীর্তনীয়াদের গান তাঁদের ততটা টানে না। বরং আখড়াগুলো থেকে মেলার তিন দিন বিনি পয়সায় খেতে পান। আর ভিক্ষাটুকুর টানেই প্রতিবছর ছুটে আসেন জয়দেব মেলায়। চাপড়ার নীলমনি পালের বয়স ৭০ পেরিয়েছে। পঞ্চাশ পেরোনোর পরেই তাঁর স্বামী মারা যান। তারপরে আর মেয়েরা কেউ আর দেখেননি। ১৮ বছর ধরে তিনি জয়দেব মেলায় আসছেন। এখনও ম্লানমুখে এসে বসেন মেলায়। তিনি বললেন, ‘‘প্রতিবারই ভাবি এ বারই মনে হয় শেষ। কিন্তু, সব বারই জয়দেব-পদ্মাবতীর টানে এখানে চলে আসি। যা পাই, তা দিয়ে দিন কয়েক ভাত রান্না করে তো খেতে পারি।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন