ফাইল বন্ধ, পুলিশ কবেই হাল ছেড়েছে

স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। বান্দোয়ানের রসিকনগর গ্রামের বাসিন্দা ছাপোষা গৃহস্থ পঞ্চানন সিং পিঠ বাঁচিয়ে চলেননি কোনও দিন।

Advertisement

সমীর দত্ত

বান্দোয়ান শেষ আপডেট: ০৯ মে ২০১৬ ০২:৩৩
Share:

স্বামী নেই। রসিকনগরের বাড়িতে বাবুই ঘাসের দড়ি বুনেই সংসার চালান তরুলতাদেবী।—নিজস্ব চিত্র

স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে নিয়ে ভরা সংসার। বান্দোয়ানের রসিকনগর গ্রামের বাসিন্দা ছাপোষা গৃহস্থ পঞ্চানন সিং পিঠ বাঁচিয়ে চলেননি কোনও দিন। কোথাও অন্যায় বা অবিচার দেখলেই বুক চিতিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন বরাবর। এই প্রতিবাদী মনোভাব পঞ্চাননবাবুকে এলাকায় জনপ্রিয় করেছিল। মৃত্যুও কি এসেছিল এই একই কারণে? সাত বছর পার করেও উত্তর মেলেনি সে প্রশ্নের।

Advertisement

দিনটা ছিল ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি। তখন দুপুর। বান্দোয়ানের কুচিয়া হাইস্কুলের সামনে রাস্তায় পড়েছিল একটা সাইকেল। তার পাশ থেকে রাস্তায় রক্তের দাগ চলে গিয়েছিল বেশ কিছুটা দূরে। সেখানে পড়েছিল পঞ্চানন সিংয়ের গুলিবিদ্ধ দেহ।

পুলিশ জানিয়েছিল, প্রথম গুলিটি শরীরে বেঁধার পরে পালানোর চেষ্টা করেছিলেন পঞ্চাননবাবু। পারেননি। তাঁকে দৌড় করিয়ে চারটি গুলিতে শরীর ফুঁড়ে দেয় আততায়ীরা। শেষে মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য বাঁ কানের পাশে, পয়েন্ট ব্ল্যাঙ্ক রেঞ্জ থেকে গুলি করা হয়।

Advertisement

বছর পঁয়ত্রিশের পঞ্চাননবাবু এলাকায় ডাকাবুকো বলেই পরিচিত ছিলেন। তাঁর কাছে কোনও দরকারে সাহায্য চেয়ে খালি হাতে ফিরেছেন বলে কেউ মনে করতে পারেন না। আর একটি পরিচয়ও ছিল পঞ্চাননবাবুর। তৃণমূল কর্মী। কিন্তু দলমত নির্বিশেষে এলাকার অধিকাংশ বাসিন্দাই তাঁকে পছন্দ করতেন।

স্ত্রী তরুলতাদেবী আর কিশোর ছেলে বনমালী এবং শিশুকন্যা হৈমবতীকে নিয়ে দিব্যি ছিলেন পঞ্চাননবাবু। সামান্য জমি। কাঠের ছোটখাটো একটা ব্যবসা। স্বচ্ছল ভাবে দিন কাটছিল। এলাকার বাসিন্দারা ধরে পড়লেন, কুচিয়া হাইস্কুলের পরিচালন সমিতির অভিভাবক প্রতিনিধি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হবে তাঁকে।

বান্দোয়ানের বাতাসে তখন বারুদের গন্ধ। মাওবাদীরা তখনও জঙ্গলমহলে সক্রিয়। রাজনীতির লড়াইয়েও হাতে হাতে ফিরছে গুলি বোমা। এ রকম অস্থির সময়ে স্বামী নির্বাচনে লড়ুন, তরুলতা দেবী একেবারেই চাননি। কিন্তু তাঁর ওজর আপত্তি ধোপে টেঁকেনি।

স্কুলে মনোনয়ন পত্র জমা দিয়ে ফেরার পথেই খুন হন পঞ্চাননবাবু। তার আগে কি কোনও হুমকি পেয়েছিলেন তিনি? তরুলতাদেবী বলেন, ‘‘জানি না। বাড়িতে কাউকে কিছু বলতেন না, পাছে দুশ্চিন্তা করি। লড়াইয়ে পিছপা হওয়ার মানুষও ছিলেন না।’’

কে বা কারা খুন করল পঞ্চাননবাবুকে? পুলিশ তদন্ত করেও তা জানতে পারেনি। ‘ফাইল ক্লোজড’। বান্দোয়ান থানার পুলিশের দাবি, এই খুন সংক্রান্ত কোনও তথ্য তাঁদের কাছে নেই। সব উপরতলায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।

তৃণমূল কর্মী ছিলেন পঞ্চাননবাবু। তিনি খুন হওয়ার পরে সিপিএম আশ্রিত দুষ্কৃতীদের দিকে অভিযোগের আঙুল তুলে সরব হয়েছিল স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব। তরুলতাদেবী আশা করেছিলেন, সরকার বদলের পরে অন্তত স্বামীর খুনের কিনারা হবে। দল এগিয়ে আসবে। কিন্তু সেই ভরসা খানখান হয়ে গিয়েছে গত আধ দশকে।

তরুলতাদেবী জানান, বেশ কয়েক বার স্থানীয় নেতাদের ধরে মন্ত্রীদের কাছে গিয়ে দরবার করেছিলেন। তাঁরা স্তোক দিয়ে দায় সেরেছেন। জীবন যুদ্ধে লড়তে লড়তে চোয়াল শক্ত হয়ে গিয়েছে তাঁর। বলেন, ‘‘আমার স্বামীর মত লোকজন শুধু রাজনীতির ঘুঁটি। তাঁরা খুন হলে নেতা মন্ত্রীদের কিছু আসে যায় না।’’

তার অভিভাবক হিসাবেই স্কুলের পরিচালন সমিতির নির্বাচনে লড়াইয়ে নামতে গিয়েছিলেন পঞ্চাননবাবু। কুচিয়া হাইস্কুলের সে দিনের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র বনমালী এখন তরতাজা তরুণ। কলেজে প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছে। ঝাড়গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে পড়াশোনা করে। বাবাকে কেন খুন হতে হয়েছিল সেই প্রশ্ন এখনও তাড়া করে ফেরে তাকে।

পঞ্চাননবাবুর মেয়ে হৈমবতী এখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী। সেই কুচিয়া হাইস্কুলেরই। চল্লিশে পা দেওয়ার আগেই জীবনযুদ্ধের ছাপ পড়েছে তরুলতাদেবীর চেহারায়। অভাব আর দুশ্চিন্তা তাঁদের নিত্যসঙ্গী। তরুলতাদেবী বলেন, ‘‘মানুষটা হঠাৎ চলে যাওয়ায় মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল। কী ভাবে সংসারটা চলবে ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছিলাম না। কখনও একশো দিনের কাজ করি, কখনও বাবুই ঘাসের দড়ি পাকিয়ে বা কাঠ বেচে দিনগুজরান হয়। ২০১২ সালে বাঁকুড়ায় আমার হাতে চল্লিশ হাজার টাকা গুঁজে দেওয়া হয়েছিল। বলা হয়েছিল, পরিবারের এক সদস্যকে চাকরি দেওয়া হবে। কিন্তু কোথায় কি!’’

স্বামীর স্মৃতি আঁকড়ে দুই ছেলে-মেয়েকে মানুষ করার লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন একা তরুলতাদেবী।

• বান্দোয়ানের রসিকনগরে ২০০৯ সালের ১৯ জানুয়ারি খুন হন তৃণমূল কর্মী পঞ্চানন সিং।

• কুচিয়া হাইস্কুলে মনোনয়ন জমা দিয়ে ফেরার পথে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। পাঁচটি গুলিতে শরীর ঝাঁঝরা করে দেওয়া হয়।

• পুলিশ তদন্ত করেও আততায়ীদের চিহ্নিত করতে পারেনি। গ্রেফতারও হয়নি কেউ। জমা দিতে পারেনি চার্জশিটও।

• ফাইল ক্লোজড। পরিবারের আক্ষেপ, তৃণমূলের সরকার আসার পরেও ওই মামলা পুনরায় খোলা হয়নি।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন