মনের জোরেই ‘অলরাউন্ডার’

৩ ডিসেম্বর ছিল বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। এখন এঁদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বলা হয়। যে প্রতিবন্ধকতা অনেক মানুষকে হীনমন্য করে তোলে, সেই প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে চলেন অনেকে।

Advertisement

দেবস্মিতা চট্টোপাধ্যায়

শান্তিনিকেতন শেষ আপডেট: ০৪ ডিসেম্বর ২০১৮ ০৩:০৪
Share:

প্রশিক্ষক: আবাসিককে সেলাইয়ের পাঠ আমিনার। নিজস্ব চিত্র

প্রতিবন্ধকতার দোহাই দিয়ে বসে থাকা নয়। মনের জোর আর কিছু একটা করে দেখানোর ইচ্ছে থেকে লড়াই ছাড়েননি আমিনা খাতুন। এ বছরই বর্ধমানের মানকর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ৮১ শতাংশ নম্বর নিয়ে পাশ করেছেন। এখন পড়ছেন বিশ্বভারতীর শারীরশিক্ষা বিভাগে।

Advertisement

৩ ডিসেম্বর ছিল বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস। এখন এঁদের বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন বলা হয়। যে প্রতিবন্ধকতা অনেক মানুষকে হীনমন্য করে তোলে, সেই প্রতিবন্ধকতাকে সঙ্গে নিয়েই এগিয়ে চলেন অনেকে। জয়ীও হন। কিছুটা এ রকমই গল্প আমিনার। আমিনা জানান, বয়স তখন মাত্র নয় মাস। ওই বয়সে আগুন কী তা জানতেন না। সবে হামাগুড়ি দিয়ে বাড়িময় ঘুরতে শিখেছেন শিশু আমিনা। আর পাঁচটা শিশুর মতোই সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। সব কিছু পাল্টে যায় শীতের এক সন্ধ্যায়। হামাগুড়ি দিতে দিতে পৌঁছে যান মেঝেতে জ্বলতে থাকা লম্ফের কাছে। ডান হাত দিয়ে ছুঁতেই উল্টে যায় লম্ফ। কেরোসিন তেল মেঝেতে ছড়িয়ে পড়তেই আমিনার কচি ডান হাতে আগুন লেগে যায়। ছড়িয়ে পরে দেহের ডান দিকের অংশে। অনেক চেষ্টার পরে প্রাণ বাঁচে। কিন্তু, খোয়া যায় ডান হাতের সব আঙুল। সেই হাতও প্রায় অকেজো। বাম হাতেও আগুনের আঁচ লেগেছিল, কিন্তু ক্ষতি কম হয়।

আমিনা জানালেন, তিনি যত দূর শুনেছেন ওই ঘটনার পরই তাঁর বাবা তাঁদের ছেড়ে চলে যান। আর ফেরেননি। আমিনার মা মণিজা খাতুন বেগম আমিনাকে নিয়ে চলে আসেন শান্তিনিকেতনের এলমহার্স্ট ইনস্টিটিউট অফ কমিউনিটি স্টাডিজের হোমে। সেখানে কয়েক মাস থাকার পরে চলে যান উত্তরপাড়ার একটি হোমে। এ বছরই বর্ধমানের মানকর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ভাল নম্বর নিয়ে পাশ করেছেন। ছোটবেলা থেকেই আমিনার ইচ্ছে ছিল শারীরশিক্ষা নিয়ে পড়ার। ইচ্ছেপূরণ করতে চলে ফের আসেন শান্তিনিকেতনে। বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন পড়ুয়া হিসেবে ভর্তি হন বিশ্বভারতীর শারীরশিক্ষা বিভাগে।

Advertisement

এতগুলো বছর পেরিয়ে গেলেও আমিনাকে ভোলেনি এলমহার্স্ট ইনস্টিটিউট। আবারও সে এই ইনস্টিটিউটের ক্ষণিকা হোমে থেকে পড়াশোনা করছে। ইনস্টিটিউটের পক্ষে প্রিয়ম মুখোপাধ্যায় এবং ঋতপা মুখোপাধ্যায় জানান, শুধু পড়াশোনা কিংবা খেলাধুলো বলে নয়, নাচ, গান, আঁকা, কবিতা লেখা সবেতেই সমান পারদর্শী আমিনা। অবসর সময়ে হোমের অন্য পড়ুয়াদের পড়ান। হোমের সুপারিনটেনডেন্ট সতী সিংহ, কাউন্সিলর মঞ্জু মহাপাত্র, চাইল্ডলাইনের জেলা কাউন্সিলর মাধবরঞ্জন সেনগুপ্তের প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমরা সব সময় আমিনার পাশে আছি। ও শুধু লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে যাক।’’

আমিনার কথায়, ‘‘ছোটবেলায় অনেকে মিশতে চাইত না। খারাপ লাগত। মাকে বলতাম। মা সাহস দিয়েছেন সব সময়। এখান হোমের দিদিরা খুব ভালবাসে। স্কুলের শিক্ষকরাও সাহায্য করেছেন।’’ একটু থেমে বলেন, ‘‘আমি নিজেকে কখনও অন্যদের থেকে আলাদা ভাবি না। আলাদা ভাবে কেউ দেখলে খারাপ লাগে।’’ বড় হয়ে খেলার শিক্ষিকা হওয়ার ইচ্ছে আছে আমিনার। সেই সম্ভবনা যে তাঁর মধ্যে আছে, জানালেন বিশ্বভারতীর শারীরশিক্ষা বিভাগের প্রধান সমীরণ মণ্ডল। তিনি বলেন, ‘‘আমিনা নিজের যোগ্যতাতেই ভর্তি হয়েছে এ বছর। ভীষণ নিয়মিত এবং বাধ্য মেয়ে। এনসিসিতে সেরা হয়েছে। ট্রেনিং ক্যাম্পে ‘অলরাউন্ডার’ খেতাব জিতে ইন্টারগ্ৰুপ প্রতিযোগিতায় নির্বাচিত হয়েছে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন