ময়ূরেশ্বরের সোঁজ গ্রামে চলছে পাঠশালা। ছবি: অনির্বাণ সেন।
শিক্ষকদের অনেকেই প্রাথমিকের চৌকাঠ পার হননি। ছেলেমেয়েদের ধরে নিজের নাম সই রপ্ত করেছেন মাত্র। কিন্তু তাঁদের কাছেই পাঠ নিচ্ছেন স্নাতকোত্তর ডিগ্রিধারী বহু শিক্ষার্থী। তা নিয়ে অবশ্য কোনও পক্ষেরই কোনও অনুযোগ নেই। হেলদোল নেই স্কুল কর্তৃপক্ষেরও। বরং তাঁদের থেকে প্রশ্রয়ই পাচ্ছেন শিক্ষকেরা।
পুথিগত বিদ্যাদানের প্রতিষ্ঠান নয়, ওই স্কুল আসলে কৃষি খামার বিদ্যালয়। সেখানে শিক্ষকতা করার যোগ্যতার মাপকাঠি প্রাতিষ্ঠানিক ডিগ্রি নয়, বিবেচিত হয় মাঠে ময়দানে কাজ করার অর্জিত অভিজ্ঞতা।
কৃষি দফতর সূত্রের খবর, দফতরের পরিচালনায় কৃষি, মৎস্য, রেশম, উদ্যানপালন এবং পশুপালন বিভাগ একত্রিত ভাবে চলতি আর্থিক বছরে কৃষিজ প্রযুক্তি ব্যবস্থাপক সংস্থা বা ‘আতমা’ প্রকল্পের আওতায় জেলায় ওই ধরণের ৪৯টি স্কুল গড়ার উদ্যোগ নিয়েছে। তার মধ্যে ইতিমধ্যেই ২২টি চালু হয়েছে। চাষিদের চাহিদা অনুযায়ী কোথাও মাছ, কোথাও পশুপালন আবার কোথাও বা কৃষি বিষয়ক স্কুল খোলা হয়েছে। চাষিদেরই দেওয়া পুকুর কিংবা জমিতে গড়া হয়েছে প্রদর্শনক্ষেত্র। ওই প্রদর্শনক্ষেত্রে প্রতিটি স্কুলে বাছাই করা ২৫ জন চাষির ৬ সপ্তাহ ধরে প্রশিক্ষণ চলছে। সপ্তাহে এক দিন সংশ্লিষ্ট দফতরের কর্তারা উন্নত প্রযুক্তির চাষের কৌশল শিখিয়ে তৈরি করছেন এক জন প্রধান শিক্ষক-সহ ২৫ জন শিক্ষক। তাঁরা আবার শেখাচ্ছেন এলাকার বাকি চাষিদের। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যাচ্ছে, শিক্ষকদের থেকে পুথিগত বিদ্যার দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন শিক্ষার্থীরা।
ময়ূরেশ্বরের সোঁজ গ্রামেও চলছে ওই রকমই কৃষি খামার বিদ্যালয় বা পাঠশালা। সেখানে শিক্ষক হিসাবে রয়েছেন সাধন মণ্ডল, সুরেন ঘোষ। তাঁরা অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। নবকুমার মণ্ডল আবার নিজের নাম সইটুকু শিখেছেন ছেলেমেয়েদের কাছে। তিনি বলেন, ‘‘নিজের বিদ্যের দৌড় তো জানি। কিন্তু গ্রামের শিক্ষিত চাষিরাও যখন মাস্টারদা, মাস্টার কাকা বলে চাষের পরামর্শ নিতে আসছেন, তখন মনে হচ্ছে এত সম্মান আমাদের ভাগ্যেও ছিল!’’
ওই স্কুলেই প্রধান শিক্ষক হিসাবে রয়েছেন উচ্চ মাধ্যমিক পাশ মিহির রায়। তিনি বলেন, ‘‘আমাদের শিক্ষকদের অধিকাংশই প্রাথমিক কিংবা মাধ্যমিক পাশ করতে পারেননি। কিন্তু তাঁদের কাছে থেকেই বহু এমএ-বিএ পাশ চাষিও কৃষি বিষয়ক পরামর্শ নিয়ে যাচ্ছেন।’’ গ্রামেরই বিএ পাশ যুবক অভিজিৎ রায়, বিকম পাশ দেবব্রত রায়, এমএ পাশ অপূর্ব মণ্ডলও জানালেন তেমনই। অভিজিৎ বলেন, ‘‘আমরা পুথিগত বিদ্যার নিরিখে শিক্ষিত ঠিকই। কিন্তু কৃষিকাজে ওরা অনেক এগিয়ে। দীর্ঘ দিনের অর্জিত অভিজ্ঞতা তো ছিলই, তার উপরে ওঁরা সরকারি প্রশিক্ষণে সমৃদ্ধ হয়েছেন। তাই ওদের কাছে চাষের পরামর্শ নিয়ে উপকৃত হচ্ছি।’’
‘আতমা’র জেলা প্রোজেক্ট ডিরেক্টর সৌমেন্দ্রনাথ দাস বলেন, ‘‘পুথিগত বিদ্যা নয়, ওই সব স্কুলের জন্য শিক্ষক হিসাবে বাছাইয়ের ক্ষেত্রে চাষিদের অভিজ্ঞতা এবং উদ্যমকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। পরবর্তী কালে শিক্ষিতেরাও তাঁদের কাছে পরামর্শ নিতেই পারেন।’’