ঢেঁকিতে চাল ভেঙে তৈরি হচ্ছে পিঠে। মাটি উৎসবে। ছবি:নিজস্ব চিত্র
হারিয়ে গিয়েছে ঢেকি-ছাঁটা চালের গুঁড়ি, কালো কলাই-বাটা দিয়ে তৈরি মুচমুচে জিলিপি বা বাড়ির তৈরি জিভে জল এনে দেওয়া ছানাবড়া। হারিয়ে গিয়েছে ডাংগুলি, শখের যাত্রাও। তবু ঐতিহ্য মেনে আজও নবান্ন উৎসবে মেতে ওঠে বাঙালি।
অগ্রহায়ণ মাসে বিভিন্ন জায়গায় বিভিন্ন দিনে নবান্ন উৎসব পালিত হয়। অনেক আগে থেকেই তার প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। সাধারণত নবান্নে নতুন ধানের আতপের প্রসাদ মুখে না দিয়ে সেই মরসুমের ধানের অন্ন কেউ গ্রহণ করেন না। তার জন্য নবান্নে প্রয়োজনীয় চালগুঁড়ির আতপের গুণমান যাচাই করে নেওয়া হয় মুঠ সংক্রান্তিতে সংগৃহীত ধানে। ওই দিন জমির সেরা ধানটি মুঠ হিসেবে আনা হয়। সেই সময় গৃহিণীরা সেই ধানের গুণগত মান যাচাই করে নেন। মন পচ্ছন্দ হলে নবান্নের জন্য সেই ধান কেটে আনা হয়। তা থেকে পুজো-সহ চালগুড়ির জন্য আতপচাল তৈরি করে নেন গৃহিণীরা।
বিভিন্ন গ্রামের, নানা বয়সের বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, এক সময় নবান্নের চালগুঁড়ির জন্য গ্রামের বধূদের মধ্যে সাড়া পড়ে যেত। তখন গ্রামে এত ধান পেষাই মেশিন ছিল না। ঢেকিই ছিল চাল কোটার অন্যতম মাধ্যম। এখন ঢেকি নেই বললেই চলে। তাই বেশির ভাগ মানুষকে মেশিনেই গুঁড়ি করিয়ে নিতে হয়। সেই ছবিটা আজও চোখের সামনে ভাসে লাভপুরের শাহআলমপুরের ৬৫ বছরের বাসন্তী মণ্ডল, ময়ূরেশ্বরের ৬০ বছরের অসীমা সূত্রধরদের। তাঁরা জানান, সে সময় সম্পন্ন গৃহস্থের বাড়িতে গোলাভরা ধান, পুকুরভরা মাছ, গোয়ালভরা গরুর মতোই বনেদিয়ানার প্রতীক হিসেবে ঢেকিশালে শোভা পেত ঢেকি। নবান্নের মাসে ভোর থেকে চালগুঁড়ির জন্য ভিড় জমাতেন ওই সব ঢেকিশালে। চালগুঁড়ি তৈরি করে নিয়ে ঘেমে-নেয়ে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে যেত। এখন আর সেই ঢেকি নেই, নেই ঢেকি পাড় দেওয়ার মতো ক্ষমতাও। তাই মেশিনেই গুঁড়ি করিয়ে নিতে হয়। কিন্তু, সেই স্বাদ মেলে না। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটাতে হয়।
ধান পেষাইয়ের মেশিনের মতো সে সময় গ্রামগঞ্জে মিষ্টির দোকানও ছিল না। অধিকাংশ পরিবারে নবান্নের মিষ্টি বাড়িতেই তৈরি করে নেওয়া হত। সেই মিষ্টির স্বাদ যেন আজও মুখে লেগে রয়েছে ময়ূরেশ্বরের ছামনার প্রণব মজুমদার, লাভপুরের ধনডাঙ্গার প্রেমানন্দ মণ্ডলদের। তাঁরা জানান, তখন প্রতি বাড়িতে গাইগরু থাকত। নবান্নের মিষ্টি তৈরির জন্য এক মাস আগে থেকে গরুর দুধ মেরে চাঁচি করে জমিয়ে রাখা হত। সেই চাঁচি দিয়েই তৈরি হত লোভনীয় ছানাবড়া। আর কালোকলাই বাটা দিয়ে তৈরি হত বোঁদে, মুচমুচে জিলিপি। তার স্বাদও ছিল আলাদা। এখন তো সব বাজার থেকে আসে।
ছিল হরেক রকম ভাজাভুজি, ঝোল, টক দিয়ে ভুঁড়িভোজের আয়োজনও। নবান্নের দিন এত বেশি পরিমাণে রান্না হত যে, পর দিন পান্ত-নবান্নে তার গতি করা হত। আমোদপুরের কালীচরণ চট্টোপাধ্যায়, কুণ্ডলার সুব্রত মুখোপাধ্যায়রা বলেন, ‘‘এখনও বাঙালির অন্যতম উৎসব নবান্ন। কিন্তু আগের মতো সেই আবেগটা আর নেই।’’
নিছক রসনাতৃপ্তি নয়। গ্রামের নিস্তরঙ্গ জীবনে বিনোদনের মাধ্যমও ছিল নবান্ন। এক সময় নবান্নের দিন প্রায় প্রতিটি এলাকায় ডাংগুলি খেলার প্রতিযোগিতা আর রাতে শখের গ্রামীণ যাত্রা ছিল অপরিহার্য। এখন দু’টিই অবলুপ্তির পথে। ময়ূরেশ্বরের লোকপাড়া গ্রামের সনৎ দলুই, রবি দলুইরা বলেন, ‘‘ছোটবেলায় ভরপেট খাওয়ার পর ডাং-গুলি খেলে হজম করতাম। এখনকার ছেলেমেয়ের ওই খেলার কথা জানেই না।’’