না তিনি বাম সমর্থিত নির্দল, না বিক্ষুব্ধ তৃণমূল। তাই তাঁর ব্যানারে লেখা ‘প্রকৃত নির্দল’। কোনও রাজনৈতিক দলের সমর্থন না থাকলেও বাঁকুড়া পুরসভার ১ নম্বর ওয়ার্ডের এই নির্দল প্রার্থীই চিন্তায় রেখেছেন পুরভোটে যুযুধান দুই রাজনৈতিক দল সিপিএম এবং তৃণমূলের প্রার্থীদের। জনসংযোগের দিক থেকেই এই ওয়ার্ডে অন্যদের টেক্কা দিচ্ছেন নির্দল প্রার্থী দেবাশিস লাহা।
২০০০ সালের পুরভোটে সিপিএমের প্রতীকে দাঁড়িয়ে হাতে গোনা কিছু ভোটে তিনি হেরে দল ছেড়েছিলেন। ২০০৫ সালে ১ নম্বর ওয়ার্ডে নির্দল প্রার্থী হিসেবে তিনি ভোটে দাঁড়ান। সে বারই তিনি প্রথম জয়ের স্বাদ পান। তবে লড়াইটা মামুলি ছিল না। বিপক্ষে ছিলেন জেলা কংগ্রেসের দাপুটে নেতা ব্রজবাসী বিশ্বাস ও সিপিএম প্রার্থী নিমাই হোতা। সে বার পুরসভায় বোর্ড গড়েছিল সিপিএম।
২০১০ সালের পুর-নির্বাচনে এই ওয়ার্ডটি মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত হয়। সে বার দেবাশিসবাবুর স্ত্রী সঞ্চিতা লাহা নির্দল প্রার্থী হয়ে লড়াই করেন। সবাইকে চমকে দিয়ে তৃণমূল প্রার্থী তন্দ্রা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বাম সমর্থিত নির্দল প্রার্থী শান্তি দাসকে হারিয়ে দেন সঞ্চিতাদেবী। পুরবোর্ড গড়ে তৃণমূল। এ বার ওয়ার্ডটি সংরক্ষণের গেরো থেকে মুক্ত হওয়ায় ফের দেবাশিসবাবুই প্রার্থী হয়েছেন। সিপিএম ও তৃণমূল প্রার্থীর মূল প্রতিপক্ষ যে তিনিই, ওয়ার্ডে গেলেই তা টের পাওয়া যাচ্ছে।
১ নম্বর ওয়ার্ডের গোপীনাথপুর মোড়েই একটি ঘরে নির্বাচনী কার্যালয় গড়েছেন দেবাশিসবাবু। তার কয়েকশো মিটার দূরে একটি ফাঁকা জায়গায় তাঁবু খাটিয়ে অস্থায়ী দলীয় কার্যালয় গড়েছে তৃণমূল। কেন তাবু খাটাতে হল? তৃণমূল প্রার্থী জগন্নাথ দে দাবি করলেন, “এলাকায় অনেকেই আমাদের ঘর দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু, ঘর পছন্দ না হওয়াতেই আমরা তাবু খাঁটিয়ে দলীয় কার্যালয় গড়েছি।’’ এলাকাবাসীর একাংশ অবশ্য জানাচ্ছেন, পছন্দসই ঘর চেয়েও না পেয়ে ব্যর্থ মনোরথ হয়ে তাঁবু খাটিয়েছে তৃণমূল। অন্য দিকে, এলাকারই এক ক্রীড়াপ্রেমী নেপালচন্দ্র দাস তাঁর ক্রীড়ার সরঞ্জাম রাখার গুদাম নির্বাচনে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন দেবাশিসবাবুকে। এখানেই শেষ নয়। দায়িত্ব নিয়ে বাড়িটিতে লাইটও লাগিয়ে দিয়েছেন। বিনিময়ে কোনও ভাড়াও নিচ্ছেন না তিনি।
রাজনীতি অবশ্য তাঁর না-পসন্দ, সাফা জানিয়ে দিচ্ছেন নেপালবাবু। তা হলে বিশেষ এক ভোট প্রার্থীকে নির্বাচনী কার্যালয় করার অনুমতি কেন দিলেন, জানতে চাইলে তাঁর উত্তর, “গনা (দেবাশিসবাবুর ডাক নাম) তো রাজনীতি করে না! নিজের স্বার্থের কথা না ভেবে যে লোকটা এলাকার উন্নয়ন করে, তাকে রাজনৈতিক নেতা বলা যায় না। আমাদের পাড়ার জেল মাঠটার কী অবস্থা ছিল! আমরা সবাই মিলে সেই মাঠ সংস্কার করিয়েছি। এই কাজে গনাও আমাদের সঙ্গে ছিল।’’
দেবাশিসবাবুর কার্যালয়ে একটি পুরনো টেবিল ফ্যান ঘরঘর শব্দে ঘুরছে। পাখাটি কার জানতে চাওয়ায় দেবাশিসবাবু বলেন, “গরমে ঘেমে একসা হচ্ছি দেখে এলাকার এক প্রৌঢ়া মীরা দে পাখাটি দিয়েছেন।’’ কাউন্সিলরের প্রতি এহেন সহানুভূতি কেন? মীরাদেবীর কথায়, “স্বামী মারা যাওয়ার পর থেকে ঘোর অনটনের মধ্যে সংসার চালাতাম। অনেক কাউন্সিলর দেখেছি। তাঁরা বাবুমশাই! কিন্তু গনা আমাকে নিজের মায়ের মতো ভালবাসে। বিধবা ভাতাও করে দিয়েছে।’’ গোপীনাথপুর মোড়ের এক চা দোকানি সমীর দত্ত দোকান গুটিয়ে স্নান করতে যাওয়ার পথে দেবাশিসবাবুর অফিসে এসে উপস্থিত। প্রচারের বিষয়ে কিছু মতামত জানাতেই অফিসে এসেছিলেন তিনি। সমীরবাবু বললেন, “গনাকে মাঝরাতে ফোন করে বিপদে আপদে ডাকতে পারি। ও তো ভিআইপি নয়। আমাদেরই মতো সাধারণ মানুষ।’’
তখন প্রচার শেষ করে বাড়ি ফিরছিলেন এই ওয়ার্ডের কংগ্রেস প্রার্থী তীর্থমোহন সেন। পথে দেবাশিসবাবুর অফিস পার করার সময় থমকে দাঁড়ালেন। তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় সারলেন দেবাশিসবাবু। গত পুরভোটে তৃণমূলের হয়ে গলা ফাটিয়েছিলেন এই ওয়ার্ডের বাসিন্দা সাধন খাঁ, তাপস দত্ত, বাপি দাসরা। তাঁরা জানিয়ে দিলেন, এ বার তাঁরা দেবাশিসবাবুর দিকে। বাঁকুড়ার প্রাক্তন সিটু নেতা শ্যামসুন্দর কুণ্ডু বলেন, “আমি ঘোর বামপন্থী। সব ভোটে বামেদের হয়ে প্রচার চালাই। কিন্তু পুরভোটে আমি গনার হয়েই বলব।’’
এই ওয়ার্ডে দেবাশিসবাবুর আর এক প্রতিদ্বন্দ্বী সিপিএমের অবিনাশ রজক। সিপিএম শিবির অবশ্য জয়ের ব্যাপারে খুব একটা আত্মবিশ্বাসী নয়। দলের বাঁকুড়া জোনাল কমিটির সম্পাদক প্রতীপ মুখোপাধ্যায় স্বীকার করে নিয়েছেন, “এই ওয়ার্ডে আমরা খুবই দুর্বল। তবে জেতার জন্য লড়াই করছি।’’ পরিস্থিতি যেমনই হোক, হাল ছাড়তে অবশ্য নারাজ তৃণমূল শিবির। তৃণমূল প্রার্থী জগন্নাথবাবুর দাবি, “ওয়ার্ডের মানুষের মনের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে গনার বিরুদ্ধে। সেই ক্ষোভকেই কাজে লাগিয়ে জিততে চাই আমরা। মানুষকে এটাও বোঝাচ্ছি, বিধবা বা বার্ধক্য ভাতা সরকারি প্রকল্প। কেউ নিজের পকেট থেকে সেই টাকা দেয় না। তাই অহেতুক সহানুভুতির কোনও জায়গা নেই।’’ পক্ষান্তরে তিনি মেনে নিচ্ছেন, বিধবা বা বার্ধক্য ভাতা দিয়ে গনা তাঁর থেকে কয়েক কদম এগিয়ে।
দেবাশিসবাবুর শিবির তৃণমূলের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসের অভিযোগ তুলছে। সাধনবাবু, শ্যামসুন্দরবাবুরা অভিযোগ করছেন, “আমাদের প্রচারে বাধা দিচ্ছে ওরা। ফেস্টুন, ব্যানার ছিঁড়ে দিচ্ছে। পুলিশে জানিয়েছি। কিন্তু পুলিশ উল্টে আমাদেরই ভয় দেখাচ্ছে।’’ দেবাশিসবাবুরও অভিযোগ, “শাসকদল ভোটের দিনে বুথ জ্যাম করার হুমকি দিচ্ছে প্রকাশ্যে। তবে ওরা পারবে না কিছু করতে। সাধারণ মানুষকে নিয়ে হামলা প্রতিরোধ করতে আমরাও জানি।’’