কুল চাষে লক্ষ্মীলাভ ময়ূরেশ্বরের গ্রামে

মেয়ের বিয়ে কিংবা ছেলের পড়াশোনা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন মিহির কোনাই, গৌরাঙ্গ ভল্লারা। কি করে মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমাবেন, কি করেই বা ছেলের পড়াশোনার খরচ যোগাবেন সেই চিন্তায় কার্যত রাতের ঘুম উবে গিয়েছিল তাঁদের। চাষ করার উদ্যোমটাই হারাতে বসেছিলেন অনেকে!

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

ময়ূরেশ্বর শেষ আপডেট: ১৮ জুলাই ২০১৬ ০০:০৭
Share:

কুলগাছের পরিচর্যা করছেন এক চাষি। —নিজস্ব চিত্র।

মেয়ের বিয়ে কিংবা ছেলের পড়াশোনা নিয়ে চরম দুশ্চিন্তায় পড়েছিলেন মিহির কোনাই, গৌরাঙ্গ ভল্লারা।

Advertisement

কি করে মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমাবেন, কি করেই বা ছেলের পড়াশোনার খরচ যোগাবেন সেই চিন্তায় কার্যত রাতের ঘুম উবে গিয়েছিল তাঁদের। চাষ করার উদ্যোমটাই হারাতে বসেছিলেন অনেকে! এখন পরীক্ষামূলক ভাবে নারকেল কুলের চাষ করে ওই দুশ্চিন্তা পেরিয়ে ইতিবাচক ভাবনা শুরু করেছেন জেলার বহু চাষি!

জেলা উদ্যান পালন দফতরও ওই কুলের চাষ লাভজনক বলে মেনে নিয়েছে। ওই দফতর সূত্রেই জানা গিয়েছে, বছর পাঁচেক আগে জেলায় বাও কুলের চাষ শুরু হয়েছে। ২০১৪-১৫ সালে জেলায় ৬০৬৩ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন ফলের চাষ হয়েছে। তার মধ্যে ২০০ হেক্টর জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির কুলের চাষ হয়েছিল। উৎপাদন হয়েছিল ১.৬৫ হাজার টন। উৎপাদনের একটা বড় অংশই হয়েছিল নারকেল কুল থেকে।

Advertisement

বিভিন্ন এলাকার চাষিরাই জানিয়েছেন, প্রথম দিকে ওই চাষ কিছুটা খরচ সাপেক্ষ হলেও একই জমিতে ‘সাথী’ ফসলের চাষ করেই সেই আবাদি খরচ উঠে যায়।

ওইসব চাষিদের হিসাব অনুযায়ী, সাধারণত ১০/১০ ফুট ব্যবধানে ১ বিঘে জমিতে ১৪০-১৫০টি কুল চারা লাগানো যায়। প্রতিটি চারার দাম পড়ে ১২০-১২৫ টাকা। অর্ডার অনুযায়ী বিভিন্ন সংস্থা ওই দামেই চারা চাষিদের বাড়িতে পৌঁচ্ছে দেয়। বছর খানেকের মধ্যে কোনও চারা নষ্ট হয়ে গেলে ফের চারা দেয় সংস্থাগুলি। চারা বসানো, সার, সেচ এবং অন্যান্য খরচ পড়ে বিঘে প্রতি ২০-২৫ হাজার টাকা। গাছের বৃদ্ধির জন্য প্রথম বছর ফুল নষ্ট করে দিতে হয়। তার পর থেকেই নুন্যতম ১০ বছর ভাল ফলন মেলে গাছগুলি থেকে।

এ জেলায় চাষিদের চারা সরবরাহ করে রামপুরহাটের একটি একটি কৃষি প্রযুক্তি সংস্থা। সংস্থার কর্ণধার ভৈরব নাগের দাবি, ‘‘বছরে দু’বার প্রতিটি গাছ থেকে ৭০-৮০ কেজি কুল মেলে। প্রথম বছরের ফসল না পাওয়ার ঘাটতি সাথী ফসলের চাষ করে পুষিয়ে যায়। ২ বছর একই জমি থেকে বিভিন্ন সব্জির পাশাপাশি আদা হলুদও চাষ করা যায়। যা থেকে অনায়াসেই ওইসব চাষের সঙ্গে কুল চাষের খরচও ওঠে যায়।’’ তিনি বলছেন, পরবর্তী কালে কুল গাছের ফাঁকে ফাঁকে হাইব্রিড ওল এবং জমির চারধারে বেড়া হিসাবে অড়হর কলাইয়ের চাষ করে বাৎসরিক খরচটুকুও সংস্থান হয়। সংস্থার দাবি, পতিত হয়ে পড়ে থাকা ডাঙা জমিতেও কুল চাষ সম্ভব।

ওই নারকেল কুলের চাষ করেই এখন হতাশা কাটিয়ে নানা স্বপ্ন বুনছেন ময়ূরেশ্বরের তিলডাঙ্গার গৌরাঙ্গ ভল্লা, লোকপাড়ার মিহির কোনাই, শিবাশীষ রায়, মিহির কোনাই, সাঁইথিয়ার রানিপুরের শান্তি পালরা। বিঘে দু’য়েক জমির মালিক গৌরাঙ্গ ভল্লা বছর খানেক আগে ১১ কাঠা জমিতে ১০০টি কুলের চারা বসিয়েছিলেন। একই সঙ্গে জমিতে আদা, হলুদের পাশাপাশি চাষ করেছিলেন বিভিন্ন সব্জিরও। সব মিলিয়ে খরচ পড়েছিল ৪০ হাজার টাকা। প্রথমবার কুলের ফুল নষ্ট করে দিতে হয়েছিল। কিন্তু সব্জি বিক্রি করেই তিনি সমস্ত খরচ ওঠার পরেও বেশকিছু টাকা উদ্বৃত্ত পেয়েছিলেন তিনি। এবারে ইতিমধ্যেই ২০ কুইন্টাল কুল বিক্রি করেছেন। গাছে রয়েছে আরও প্রায় ১২ থেকে ১৫ কুইন্টাল কুল। যার দাম কিলোপ্রতি ২৫-৩০ টাকা।

গৌরাঙ্গ বলেন, ‘‘অর্থাভাবে নিজে অষ্টম শ্রেণির বেশি পড়া এগোয়নি। প্রথাগত চাষ করে ভাত কাপড়ের সংস্থানটুকুও ভালভাবে হচ্ছিল না। এখন কুল চাষ করে আমার এক ছেলেকে বেসরকারি ইঞ্জনিইয়ারিং কলেজে পড়াতে পারছি।’’ স্বপ্ন দেখছেন মিহির কোনাইও। নিজের কোনও জমি নেই। তাঁর দুই বিবাহযোগ্যা মেয়ে। তাঁদের বিয়ের চিন্তায় রাতের ঘুম উবে গিয়েছিল মিহিরবাবুর। এখন কুল চাষ করে সেই চিন্তা অনেকটাই ঘুচে গিয়েছে।

জেলা উদ্যান পালন দফতরের সহ-অধিকর্তা সুবিমল মণ্ডল বলেন, ‘‘ওই কুলের চাষ লাভজনক হওয়ায় চাষিদের আগ্রহ বাড়ছে। রাষ্ট্রীয় কৃষি বিকাশ যোজনায় ওই ধরণের কুল চাষের প্রস্তাব ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়েছি। অনুমতি মিললে ওই কুল চাষের জন্য চাষিদের উৎসাহিত করা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন