অবশেষে। সোনামুখীতে শুভ্র মিত্রের তোলা ছবি।
প্রতিরোধের হুঙ্কার, বহিরাগত ধরে দেওয়া এবং ‘ফেয়ার ইলেকশন’ বলে পুলিশ প্রশাসনকে দরাজ শংসাপত্র।
পুরভোটের আগে ও পরে এই সবই করতে ও বলতে শোনা গিয়েছে জেলা বাম নেতৃত্বকে। কিন্তু সেই ‘ফেয়ার ইলেকশন’-ই রাঢ়বঙ্গে সবেধন নীলমণি হয়ে থাকা পুরসভার ক্ষমতা থেকেও সরিয়ে দিল সিপিএম তথা বামফ্রন্টকে! টানা ১০ বছর সোনামুখী পুরসভা চালানোর পরে এ বার বিরোধী আসনে বসতে হচ্ছে সিপিএমকে। ৯-৬ ফলে সোনামুখী শহর দখল করে নিল তৃণমূল। আর এর পরেই তৃণমূল কর্মীরা কটাক্ষ করতে শুরু করেছেন, সোনামুখীতে বামফ্রন্টেরই ‘নয়-ছয়’ হয়ে গেল! বামফ্রন্টের খাতা বন্ধ হয়ে গেল বিষ্ণুপুরেও। পাশাপাশি দুই পুর-শহরে এই বাম-বিপর্যয়ের কারণ অবশ্য দলের জেলা নেতৃত্ব স্পষ্ট ভাবে ব্যাখ্যা করতে পারেননি।
আগে থেকেই সোনামুখীতে শাসকদলের বিরুদ্ধে ভোটের দিনে সন্ত্রাস চালানোর আশঙ্কার কথা জানিয়ে কমিশন থেকে জেলা প্রশাসনের কাছে সরব হয়েছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। পুলিশও পাখির চোখ করে সোনামুখীকে। সিপিএম কর্মী ও বাসিন্দাদের একাংশের সাহায্যে কয়েকজন বহিরাগতকে ভোটের সকালে পুলিশ আটকও করে। বোমাও উদ্ধার করা হয়। ভোটের পরে পুলিশের ভূমিকায় সন্তোষও প্রকাশ করেন বিরোধীরা। কিন্তু মঙ্গলবার পুরসভার ক্ষমতা হারানোর পরেই সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য অমিয় পাত্র দাবি করেছেন, ‘‘রিগিং আটকানো গেলেও সোনামুখীতে শেষ মুর্হূতে প্রলোভন দেখিয়ে, টাকা ছড়িয়ে ভোট করেছে তৃণমূল। হারার কারণ এমনটাই বলে প্রাথমিক ভাবে মনে হচ্ছে। এ নিয়ে দলীয় স্তরে পরে আলোচনা হবে।” আর পুরভোটে জিতে সোনামুখীর বিধায়ক দীপালি সাহা (তাঁর সঙ্গীদের বিরুদ্ধেই মূলত সিপিএম সন্ত্রাসের আশঙ্কা করেছিল) বলছেন, ‘‘মানুষই ভোটের মাধ্যমে অমিয়বাবুরদের মুখে ঝামা ঘষে দিল। আমাদের আর কিছু বলার নেই। উনি তো বলেছিলেন পুলিশ-প্রশাসন ওঁদের সহায়তা করেছে। কিন্তু মানুষ ছিলেন আমাদের পাশে।’’
এই পুরশহরে গতবার তৃণমূল ৭টি এবং বামফ্রন্ট ৮টি ভোট পেয়েছিল। অনাস্থা আনার চেষ্টা করে পুরপ্রধানের পদ থেকে সিপিএমের কুশল বন্দ্যোপাধ্যায়কে সরানোর চেষ্টা করেছিলেন বিরোধী দলনেতা সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়। শেষ পর্যন্ত তা সম্ভব হয়নি। এ বার সেই কুশলবাবুকে ভোটের ময়দানে একই ওয়ার্ডে পেয়ে সুরজিৎবাবু হারিয়ে দিলেন। ওই ওয়ার্ডের লড়াইয়ের দিকে তাই অনেকের নজর ছিল। জয়ের পরে সুরজিৎ তাই বলছেন, ‘‘১০ বছরে সিপিএমের অনেক ‘উন্নয়ন’ দেখেছে সোনামুখীর মানুষ। তাই এ বার প্রকৃত উন্নয়ন দেখতে তাঁরা মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রার্থীদের জিতিয়েছেন।’’ সিপিএমের জেলা কমিটির সদস্য শেখর ভট্টাচার্যের স্বীকারোক্তি, ‘‘ভোটের ক’দিন আগে আমাদের নিচুতলায় প্রচারের কাজে ঢিলেমি হয়েছে। প্রচারে জোর না দিয়ে আমরা শাসকদলের বিরোধীদের আটকাতে বেশি নজর দিই। সেই সুযোগে ওরা জনসংযোগ আরও বাড়িয়ে এই সাফল্য পেয়ে গেল।’’ একই সঙ্গে তাঁর মন্তব্য, ‘‘এই শহরে আমরা জনবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। এ বার আমরা গঠনমুলক বিরোধিতা করব।’’
তবে দীপালি ও সুরজিতের বিরোধও এই শহরের অবিদিত নয়। তাই সংখ্যা গরিষ্ঠতা পাওয়ার পরে এখন কে পুরপ্রধানের আসনে বসেন সেটাই শহরবাসীর চর্চার বিষয় হয়ে উঠেছে। এ দিনই দীপালিদেবীর অনুগামীরা বলতে শুরু করেছেন, শহরবাসী দীপালিদিকেই পুরপ্রধান হিসেবে দেখতে চাইছেন। তাঁদের মনের কথা আমরা দীপালিদিকে জানিয়েছি। যদিও দীপালিদেবী বলছেন, ‘‘কে পুরপ্রধান হবেন, তা দিদি (মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়) ঠিক করবেন।’’ অন্য দিকে, সুরজিৎবাবুর ঘনিষ্ঠদের আশঙ্কা, ‘দীপালিদেবী অল্পেতেই মাথা গরম করে ফেলেন। তাঁকে পুরপ্রধান করে হলে উন্নয়ন তো হবেই না, উল্টে তাঁর আচার আচরণ নিয়ে বিরোধীরা তো বটেই সাধারণ মানুষও দল সম্পর্ক সমালোচনা করার সুযোগ পেয়ে যাবে। যদিও সুরজিৎবাবু বলছেন, ‘‘পুরপ্রধানের পদ নিয়ে আমি আপাতত ভাবতে চাইছি না। ওটা দল দেখবে।’’ তৃণমূলের ওই দুই নেতা-নেত্রীর এই মন্তব্যেই অশান্তির ছায়া দেখছেন অনেকে। এই প্রসঙ্গেই অমিয়বাবুর কটাক্ষ, ‘‘সোনামুখীতে বোর্ড গঠন নিয়ে সুরজিৎ-দীপালির ঝামেলা এ বার কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, সবাই দেখুক। ফলে ওরা জিতলেও শহরের কাজটা তেমন হবে না। শহরবাসী শুধু দুই গোষ্ঠীর কসরৎ দেখে যাবেন।’’ যদিও তৃণমূলের বাঁকুড়া জেলার পর্যবেক্ষক তথা সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী বলেন, ‘‘সোনামুখী পুরসভা আমরা দখলে আনতে পেরে খুশি। এ বার উন্নয়ন হবে।’’
বামেদের বিপর্যয় ঘটেছে বিষ্ণুপুরেও। গতবার যে তিনটি আসন পেয়ে বিষ্ণুপুরে বামেরা নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রেখেছিল, এ বার সবকটিই তাদের হাতছাড়া হয়েছে। সেই জায়গায় এ বার প্রথম দু’টি আসন পেয়ে বিষ্ণুপুরে খাতা খুলল বিজেপি। একটি গিয়েছে তৃণমূলের গোঁজ নির্দল প্রার্থীর দখলে। গতবারের মতো এ বারও ১৬টি আসন পেয়ে জয়জয়কার সেই তৃণমূলেরই। ষষ্ঠ বারের মতো এ বার শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে বোর্ড গড়তে চলেছে তারা। তাই বিষ্ণুপুরে এ বার লাল আবিরের দেখা নেই। শহরের বিভিন্ন প্রান্তে শুধু সবুজ আবিরই উড়েছে।
এখানে এ বার সিপিএমের ভরাডুবি কেন হল? অমিয়বাবুর স্বীকারোক্তি, ‘‘ওখানে সত্যিই আমাদের সংগঠন দুর্বল।’’ কিন্তু এই শহরের সব ক’টি ওয়ার্ডে এ বার প্রার্থী দিতে না পারলেও বিজেপি দু’টি আসনে জিতে দেখিয়ে দিয়েছে, তাদের সমর্থনও তৈরি হচ্ছে। হলুদ আবির ছড়িয়ে বিষ্ণুপুরের রাস্তায় নাচতে দেখা গেল বিজেপি কর্মীদের। দলের বিষ্ণুপুর সাংগঠনিক জেলা সভাপতি স্বপন ঘোষ বলেন, “বিষ্ণুপুরে আমাদের সংগঠন যে বাড়ছে তার প্রমাণ পাওয়া গেল। আগামী বিধানসভায় আরও জোর লড়াই দেব।” পুরসভায় বিরোধী আসনে বসে তাঁর দল যোগ্যতার সঙ্গে কাজ করে যাবে বলে জানিয়েছেন তিনি।
টানা পাঁচবার এই শহরের পুরপ্রধানের দায়িত্ব সামলেছেন শ্যামবাবু। মন্ত্রীত্ব পেয়েও পুরপ্রধানের পদ ছাড়েননি। প্রার্থী নির্বাচন করা থেকে প্রচারে দলকে টেনে নিয়ে যেতে তিনিই মুখ্য ভূমিকা নিয়েছিলেন। দয়ের পরে তিনি বলেন, “আমরা সারা বছর মানুষের সঙ্গে থাকি। বিরোধীদের মতো শুধু ভোটে দাঁড়াবার সময় নয়। ফলে বার বার এলাকার মানুষ আমাদের জেতান। এই জয় আমাদের নয়। তামাম বিষ্ণুপুরবাসীর।” সবুজ আবিরে অকাল হোলি শুরু হয় বিষ্ণুপুরে।