ঘাসফুলের দুর্গে বিরোধীই পদ্ম

জল-সমস্যা জলেই, সিউড়ি তৃণমূলের

জল নিয়ে এত হইচই শেষ পর্যন্ত জলেই গেল! কাজে এল না স্বপন-ফ্যাক্টরও। পুরসভার ১৯টির মধ্যে ১৫টি আসনই ছিনিয়ে নিয়ে ফের সিউড়ির দখল নিল তৃণমূল। বিরোধীদের মধ্যে ৩টি আসন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রইল কংগ্রেস। একটি আসন পেয়ে বিজেপি কোনও রকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারলেও খাতাই খুলতে পারল না বামেরা। সম্মানরক্ষার লড়াইয়ে প্রত্যাশা মতো দলকে জয়ী করে শেষ হাসি হাসলেন সেই তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলই।

Advertisement

দয়াল সেনগুপ্ত

সিউড়ি শেষ আপডেট: ২৯ এপ্রিল ২০১৫ ০১:২৯
Share:

উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়কে নিয়ে উচ্ছ্বাস তৃণমূলের। ছবি: তাপস বন্দ্যোপাধ্যায়।

জল নিয়ে এত হইচই শেষ পর্যন্ত জলেই গেল! কাজে এল না স্বপন-ফ্যাক্টরও। পুরসভার ১৯টির মধ্যে ১৫টি আসনই ছিনিয়ে নিয়ে ফের সিউড়ির দখল নিল তৃণমূল। বিরোধীদের মধ্যে ৩টি আসন নিয়ে দ্বিতীয় স্থানে রইল কংগ্রেস। একটি আসন পেয়ে বিজেপি কোনও রকমে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারলেও খাতাই খুলতে পারল না বামেরা। সম্মানরক্ষার লড়াইয়ে প্রত্যাশা মতো দলকে জয়ী করে শেষ হাসি হাসলেন সেই তৃণমূল জেলা সভাপতি অনুব্রত মণ্ডলই।

Advertisement

অথচ তৃণমূল পরিচালিত এই পুরসভার বিরুদ্ধেই পুরপরিষেবা নিয়ে মানুষের ক্ষোভের অন্ত নেই। এই পুরসভার বিদায়ী বোর্ডের বিরুদ্ধে কেন্দ্রীয় জল প্রকল্প ও বস্তি উন্নয়নের টাকা নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছিলেন খোদ দলেরই বিধায়ক (বর্তমানে নির্বাসিত) স্বপনকান্তি ঘোষ। যার পরে শাসকদলের বিরুদ্ধে একযোগে সরব হয়েছিলেন সব বিরোধী দল। আর এই সেই পুরসভা, যেখানে গত লোকসভা ভোটের ফলে অধিকাংশ ওয়ার্ডেই পিছিয়ে ছিল শাসকদল। জেলা সদরের এই পুরসভাকেই লড়াইয়ের ময়দানে সব চেয়ে কঠিন জায়গায় রেখেছিল শাসকদলও। সেখানেই কিনা তৃণমূলের পক্ষে এমন একচেটিয়া ফল?

বিরোধীদের পাশাপাশি চমকে গিয়েছেন শাসকদলেরও কেউ কেউ!

Advertisement

রাজনীতির কারবারিদের ব্যাখ্যায়, বিরোধীদের এমন কাহিল অবস্থার পিছনে বেশ কয়েকেটি কারণ রয়েছে। প্রথমত, বামেদের সংগঠন সিউড়িতে অনেক দিন ধরেই দুর্বল হয়ে পড়েছে। এমনকী, যখন তাদের স্বর্ণযুগ চলছে, তখনও সিউড়ি পুরসভায় সিপিএম-সহ অন্য বাম শরিক দলগুলির তেমন উল্লেখযোগ্য উপস্থিতি ছিল না। দুই, এ বার যাঁদের প্রার্থী হিসাবে বাছা হয়েছিল, তাঁদের কয়েক জনকে নিয়ে প্রশ্ন ছিল। তাঁদের কেউ কেউ একাধিক বার বামেদের টিকিটে জয়ী হলেও তার পর দলবদল করে কখনও কংগ্রেস কখনও তৃণমূলে গিয়েছেন। আবার ফেরত এসে বামেদের হয়ে ভোটের ময়দানে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নেমেছেন। যা হয়তো দলের ভোট-বাক্সে থাকা অনেক মানুষেরই পছন্দ হয়নি। সর্বোপরি ভোটের প্রচার পর্বের চূড়ান্ত মুহূর্তে পার্টি কংগ্রেসে যোগ দেওয়ায় দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রচারে না থাকাও একটা ফাঁক তৈরি করেছে। এ বার আসা যাক বিজেপি-র কথায়। সিউড়ি শহরে বিজেপি-র সংগঠন মোটেও মজবুত নয়। দলেরই এক নেতা মানছেন, ‘‘প্রবল বিজেপি হাওয়া এবং পুরপরিষেবা নিয়ে ক্ষোভ থেকে শহরবাসী গত লোকসভায় বড় অঙ্কের ভোট দিয়েছিল ঠিকই। কিন্তু, সেই অঙ্ক পুরভোটে কাজ করেনি।’’ তার কারণ হিসাবে আসন নিয়ে কোন্দল প্রকাশ্যে আসা এবং তার জেরে বেশ কিছু নেতা-কর্মীর ভোটের ময়দান থেকে সরে আসাকেই তিনি দুষছেন।

তবে, বিরোধী দল হিসাবে সব চেয়ে ভাল জায়গায় থাকা কংগ্রেস অবশ্য সংগঠনের ক্ষেত্রে বাকি দুই দল থেকে কিছুটা এগিয়েই ছিল। শহরজুড়ে কংগ্রেসের একটা সমর্থনও ছিল। কিছু গ্রহণযোগ্য প্রার্থী বাছাইয়ের জন্য ফলও মিলেছে বলে নেতাদের মত। তবুও পুরসভার বিরুদ্ধে যে রকম সর্বাত্মক প্রচার করার প্রয়োজন ছিল, সেখানে কিছুটা পিছিয়েই শুরু করেছিল কংগ্রেস। আর যে মানুষটি ময়দানে নামলে প্রচারে ভিন্ন মাত্রা পেতেও পারত, সেই স্বপনবাবু দুর্নীতি নিয়ে আদালতে মামলায় গেলেও গোটা পুরভোটে আশ্চর্য নীরব রয়ে গেলেন। দুর্নীতি নিয়ে মানুষের কাছে কেন পৌঁছনো গেল না? স্বপনবাবুর প্রতিক্রিয়া, ‘‘আমি যে অভিযোগ তুলেছি, তা প্রমাণিত না হওয়া পর্যন্ত সকল মানুষের কাছে পৌঁছনো সম্ভব নয়। কিন্তু, ভোটে জেতা-ই মানে যে ওরা দুর্নীতি-মুক্ত হয়ে গেলেন, তা কিন্তু নয়।’’

ঘটনা হল, পুরপরিষেবা নিয়ে ক্ষোভ, জলপ্রকল্পে দুর্নীতির অভিযোগ বা বিদায়ী তৃণমূল পরিচালিত বোর্ডের যে যে দুর্বল জায়গা ছিল এবং যেখান থেকে প্রত্যাঘাত আসতে পারে— সেই প্রসঙ্গ এড়িয়ে না গিয়ে সর্বাত্মক প্রচারে নেমেছিল শাসকদল তৃণমূল। জেলার শীর্ষ নেতারা রাতদিন এক করে প্রচার তো চালিয়েইছেন। সব সমস্যার সমাধান করে দেওয়া হবে অঙ্গীকারের পাশাপাশি দলকে আরও একটা সুযোগ দেওয়ার আর্জিও জানিয়েছিলেন। সেই দলে অনুব্রত থেকে শুরু করে জেলার সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরীও ছিলেন। এমনকী, ভোটের ক’দিন আগেই লিফলেট বিলি করে জলপ্রকল্পে বিলম্বের জন্য শহরবাসীর কাছে ক্ষমাও চেয়ে নিয়েছেন খোদ ফিরহাদ হাকিমও।

সিউড়িতে সব দিক থেকে তৃণমূলের এই ঝাঁপিয়ে পড়াই তাদের পক্ষে গিয়েছে বলে মনে করছে বিরোধীরাই। বিজেপি-র জেলা আহ্বায়ক অর্জুন সাহা বলছেন, ‘‘অন্য পুরসভায় আমাদের ফল ভাল। এমনকী, বোলপুরেও আমরা একটি আসন পেয়েছি। সেখানে সিউড়ির এই ফল মনখারাপ করা।’’ আর দলের এমন হারের পিছনে শাসকদলের চাপা সন্ত্রাস ও অর্থনৈতিক সন্ত্রাসকেই দায়ী করেছেন সিপিএমের সিউড়ি জোনাল সম্পাদক দেবাশিস গঙ্গোপাধ্যায়। জয়ের পরে অবশ্য বিরোধীদের দাবিকে গুরুত্বই দিতে নারাজ তৃণমূল নেতারা। জয়ের পরে বিদায়ী পুরপ্রধান উজ্জ্বল মুখোপাধ্যায়ের জবাব, ‘‘সিউড়ির মানুষ অপপ্রচারের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছেন।’’

এ বারও পুরপ্রধানের পদের এই উজ্জ্বল দাবিদার।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
আরও পড়ুন