হরিপ্রসাদ উচ্চ বিদ্যালয়ের মাঠে চলছে বোমাবাজি। ছবি: সব্যসাচী ইসলাম
খবর আসছিল অন্য এলাকার মতো নলহাটি ১ পঞ্চায়েত সমিতিতেও শাসকদলের আশ্রিত দুষ্কৃতীরা নাকি বিরোধীদের মনোনয়নে বাধা দিচ্ছে। জানতে পারি, বৃহস্পতিবার বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস প্রার্থীরা মনোনয়ন জমা দেবেন। গোলমালের আশঙ্কায় সকাল সাড়ে এগারোটা নাগাদ নলহাটি পৌঁছই। সেখানে পৌঁছনোর আগেই খবর আসে নলহাটি হরিপ্রসাদ হাইস্কুল মাঠে কিছু আগেই পাঁচটা বোমা পড়েছে। আমার সঙ্গী চিত্র সাংবাদিক সব্যসাচী ইসলাম এবং অন্য সাংবাদিকরা মাঠ থেকে যথেষ্ট দূরে নিরাপদ ভেবে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তখন কী করে বুঝব আমাদের জন্য কী অপেক্ষা করছে?
বরং তখন মনে পড়ল, মাস আটেক আগে নলহাটি পুরসভা নির্বাচনে এই স্কুল মাঠ লাগোয়া এলাকার নলহাটি হাইস্কুলে বহিরাগতদের বুথ দখল এবং ইভিএম লুঠের ঘটনা। নলহাটির মতো শান্ত, বহু দিনের চেনা শহর সে দিন যেমন বহিরাগতরা দাপিয়ে বেড়িয়েছিল, এ দিনও দেখলাম শহরে বহিরাগত কিছু দুষ্কৃতী যেন বোমা গিয়ে খেলা করে গেল! ব্লক অফিস থেকে মনোনয়ন জমা দিয়ে ফিরছে আমার গ্রামের তৃণমূল কর্মীরা। দেখা হতেই এক জন বলল এ সবের কী প্রয়োজন বুঝতে পারছি না দাদা। কথা এগোতে এগোতে বোমের আওয়াজ থামল। বারুদের গন্ধ ও ধোঁয়ায় তখন আকাশে ভরে গিয়েছে। হরিপ্রসাদ হাইস্কুল মাঠ লাগোয়া পলিটেকনিক কলেজ থেকে বেরিয়ে আসছে পড়ুয়ারা। কথা বলতেই এক জন বলল, ‘‘পরীক্ষা ছিল তাই এসেছি। এমন পরিস্থিতিতে আর থাকব না। বাড়ি চলে যাচ্ছি।’’
দুপুর একটা নাগাদ নলাটেশ্বরী মন্দির লাগোয়া রাস্তা থেকে ভেসে এল বামেদের শ্লোগান। দেখতে দেখতে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস প্রার্থীদের বড়সড় মিছিল ব্লক অফিসের দিকে এগিয়ে চলল। সামনে প্রাক্তন সাংসদ রামচন্দ্র ডোম, প্রাক্তন বিধায়ক দীপক চট্টোপাধ্যায় এবং তির-ধনুক হাতে আদিবাসী কয়েক জন যুবক এবং বৃদ্ধ। দেখে মনে হল, যে কোনও মূল্যে তারা আজ মনোনয়ন জমা দেবেই। বাম, কংগ্রেস কর্মীদের লোক সমাগম এবং মিছিলের আওয়াজ দেখে দূর থেকে দেখতে পেলাম মাঠের মধ্যে যারা এত সময় বোমাবাজি করছিল তারা সব ছুটে মাঠ দিয়ে পালাচ্ছে। ওদের পালানো দেখে রণক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য আরও বেশি প্রস্তুত হতে লাগল বাম ও কংগ্রেস কর্মীরা।
ব্লক অফিস থেকে তখনও ২০০ মিটার দূরত্ব। রেজিস্ট্রি অফিস লাগোয়া জঙ্গলে ঘেরা কবরস্থান। আচমকা কিছু একটা যেন বাম পায়ের উরুর উপরে বিঁধল। জ্বালা জ্বালা করে উঠল। বুঝতে পারলাম কিছু একটা হয়েছে। আশেপাশে ঠিক তখনই বোম পড়ায় সেই শব্দ কানেও এল না। তখন নিজের কথা ভাবার সময় নেই। ব্লক অফিস লাগোয়া তৃণমূলের ক্যাম্প কাছে। তারা আসতেই বাম এবং কংগ্রেস কর্মীরা আরও বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠল। ‘ধর ব্যাটাদের, মার ওদেরকে।’ ওদের সঙ্গে এগিয়ে চললাম আমিও। ব্লক অফিস লাগোয়া তৃণমূলের ক্যাম্প ফাঁকা। সামনে রাখা মোটরবাইক ভাঙচুর করছে বামফ্রন্ট ও কংগ্রেস কর্মীরা। এ দিকে, ব্লক অফিস পৌঁছতেই পায়ের জ্বালা এবং ব্যথা বাড়তে লাগল। সঙ্গী চিত্র সাংবাদিক সব্যসাচীকে ঘটনার কথা বললাম। এগিয়ে এল অন্যরাও। সকলে মিলে আমাকে নিরাপদ জায়গায় যেতে বলল।
কিন্তু কোথায় যাব? সামনের মিছল থেকে উড়ে যাচ্ছে ঢিল। পাল্টা হিসেবে তাদের দিকে ছুটে আসছে পাথর। ব্লক অফিস চত্বরে বোমা পড়ল। এত কিছুর মাঝে কোথায় একটু নিরাপদ জায়গা পাবো বুঝে উঠতে পারছি না। মোবাইল চালু করার চেষ্টা করলাম। পারলাম না। দেখলাম ওটা ভেঙে গিয়েছে। বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমের এক চিত্র সাংবাদিক এবং এক দৈনিক কাগজের সাংবাদিক আমাকে নলহাটি ১ ব্লক হাসপাতালে নিয়ে যায়। সেখানে দেখি রামচন্দ্র ডোম, গৌতম ঘোষের চিকিৎসা চলছে। চিকিৎসক পরীক্ষা করলেন। চিকিৎসক বললেন, ‘‘পায়ের আঘাত গুলিরও হতে পারে। আবার বোমার সপ্লিন্টারও হতে পারে। তবে ভিতরে কিছু ঢুকে নেই।’’ বেরিয়ে এলাম হাসপাতাল থেকে। বুঝতে পারলাম না কী ভাবে কী হল।
আমার ভাল লাগার এই শহর। এত দিনের চেনা শহর। সেখানেই এমন অবস্থায় পড়তে হতে পারে ভাবতে পারিনি। বাড়ি ফিরলাম। স্ত্রী শুনে কেঁদে ফেললেন। ছেলে, মেয়ে ঘুমোচ্ছিল। এক সময় উঠে এসে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘বাবা, এর শেষ কোথায়?’— বিশ্বাস করুন, জবাব দিতে পারিনি।