লাটাই আছে, ঘুড়ি সব ভোকাট্টা

বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বিকেল মানেই পেটকাটি চাঁদিয়াল, ময়ূরপঙ্খী ঘুড়ি, সতরঞ্জি, লাট্টু আর লাটাই বগলদাবা করে সোজা চিলেকোঠার উপরে। ভাদ্রমাসের অরন্ধনের দিন বিশ্বকর্মা পুজো আর বৈশাখে অক্ষয় তৃতীয়া— এই দু’টি পার্বণেই এ রাজ্যে ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদাতা

মহম্মদবাজার শেষ আপডেট: ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৬ ০০:৫৬
Share:

উড়িয়ে দিলাম। শনিবার মহম্মদবাজারে। —অনির্বাণ সেন

বিশ্বকর্মা পুজোর দিন বিকেল মানেই পেটকাটি চাঁদিয়াল, ময়ূরপঙ্খী ঘুড়ি, সতরঞ্জি, লাট্টু আর লাটাই বগলদাবা করে সোজা চিলেকোঠার উপরে।

Advertisement

ভাদ্রমাসের অরন্ধনের দিন বিশ্বকর্মা পুজো আর বৈশাখে অক্ষয় তৃতীয়া— এই দু’টি পার্বণেই এ রাজ্যে ঘুড়ি ওড়ানোর রেওয়াজ। কিন্তু সেদিনের সেই আকাশজুড়ে রঙিন ঘুড়ির ওড়াওড়ি আর কোথায়! এখন লাটাই হাতে ভোকাট্টা ঘুড়ির পিছনে ছোটার সময় বা কই? তাই শরতের আকাশে আর আগের মতো ঘুড়ি উড়তে দেখা যায় না। ফিকে হতে হতে দূরের আকাশে যেন বা ঘুড়ির স্মৃতি মুছে গিয়েছে। কোথাও কোথাও তাই পুরনো দিন ফিরিয়ে দিতেই বিশেষ দিনে শুরু হয়েছে ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতা। মহম্মদবাজারের ‘আঙ্গারগড়িয়া সৃজনী শিক্ষানিকেতন’ ঠিক তেমনই এক প্রতিযোগিতার আয়োজন করেছিল শনিবার। কাশবন পেরিয়ে সুতোর প্যাঁচ আর লাটাইয়ের দম দেখতে হাজির ছিল দশ-বিশ গাঁয়ের মানুষ! ঘুড়ি ওড়ালেন আদিবাসী সম্প্রদায়ের মহিলারাও।

‘‘প্রস্তুতি শুরু হতো বেশ কয়েক দিন আগে থেকে। কলকাতা থেকে ঘুড়ি আসত। কখনও জেলার অন্য জায়গা থেকেও। তবে বাড়িতেও ঘুড়ি বানানোর রেওয়াজ ছিল। বাড়িতে নানারকম কাঠি, রঙিন কাগজ, আঠা, লাটাই— কতো যে তার যোগাড়,’’ বলছিলেন এলাকার এক প্রবীণ। একসময় বহু বাড়িতেই ঘুড়ি ওড়ানোর দস্তুর ছিল। নানা রকমের ঘুড়ির সঙ্গে ছিল নানা রঙের সুতোও। ঘুড়ি তৈরির ফিনফিনে কাগজ আসত লখনউ থেকে। সেই কাগজ কেটে বেলের আঠা দিয়ে ঘুড়ি তৈরি হত। চিৎপুরের হরিহর পালদের দোকান থেকেও আসত সুতো আর মাঞ্জার জিনিস।

Advertisement

এখন ছবি বদলে গিয়েছে! ভাঙা লাটাই হয়তো সাবেক জিনিসের ভিতর অযত্নে মিলবে। ঘুড়িগুলো কবে যেন ভোকাট্টা!

সাঁইথিয়ার সোমনাথ দত্ত, বাবুন মজুমদার বলেন, ‘‘এলাকায় একসময় চার ছক্কা, লাট্টু, শতরঞ্জি, পেটকাটি চাঁদিয়াল খুবই জনপ্রিয় ঘুড়ি ছিল। এখন চিনের ড্রাগন ঘুড়ি খুবই জনপ্রিয়। সাবুর আঠা ও কাঁচের গুঁড়ো দিয়ে আগে মাঞ্জা দেওয়া হত সুতোয়। এখন রেডিমেড সুতোতেই ঘুড়ি ওড়ান বেশিরভাগ। তবে এই প্রতিযোগিতার ফলে নতুন প্রজন্মের মধ্যেও ঘুড়ি নিয়ে আগ্রহ বাড়ছে।’’ এ দিন সকালে মহম্মদবাজার পশ্চিমপাড়া প্রাইমারি স্কুল লাগোয়া কালীতলার মাঠে ঘুড়ি লাটাই হাতে প্রতিযোগিতায় যোগ নিতে হাজির হয়েছিল ২০টি দল।

ঘুড়ি উড়ানো দেখতে মাঠের চারধারে শয়ে শয়ে দর্শক এসে জমায়েত করে। আয়োজক সংস্থা সূত্রের খবর, প্রতিটি দলের সদস্য তিনজন। অর্থাৎ তিনজন মিলে একটি ঘুড়ি ওড়াবেন। এবং নির্দিষ্ট সময় বেলা ১২টার মধ্যে প্রতিযোগিতা শেষ হওয়ার কথা। কর্তৃপক্ষের সবুজ সঙ্কেত পেতেই পৌনে এগারোটা নাগাদ আকাশে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে যায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় ঘুড়ির কাটাকাটি খেলাও। শোনা যায় সেই পরিচিত শব্দ ভোকাট্টা। কিছু দর্শক কাটা ঘুড়ি পিছনে ভোকাট্টা ভোকাট্টা বলে দৌড় লাগায়। প্রতিযোগিতায় যুগ্মভাবে প্রথম হয় মহম্মদবাজারের গ্রিনভ্যালি ও ফ্লাইং ফায়ার। দুটিই আদিবাসী দল। গ্রিনভ্যালির সোম মারান্ডি ও ফ্লাইং ফায়ারের সোম মুর্মু— দুই অধিনায়কেরই আফসোস, অল্পের জন্য একে অপরকে হারাতে পারলাম না। দু’জনে হাত মিলিয়ে বলেন, ‘‘সামনে বছর দেখব।’’

আয়োজক সংস্থার পক্ষে কৃষ্ণেন্দু গড়াই বলেন, ‘‘এখন ছোটো থেকে পড়াশোনার চাপ। তা শেষ হতে না হতেই প্রতিষ্ঠিত হওয়ার চাপ। যার ফলে শরতের আকাশে আর সেভাবে ঘুড়ি দেখা যায় না। তাই এলাকার লোকজনের স্মৃতি উস্কে দেওয়া ও পুজোর দিনে আনন্দ মেতে থাকার জন্যই গত বছর থেকে ঘুড়ি উড়ানো প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। এবারে যে দল দুটি যুগ্ম ভাবে প্রথম হয়েছে তাঁদেরকে আগামী দুই ফেব্রুয়ারি সংস্থার প্রতিষ্ঠা দিবসে পুরস্কৃত করা হবে।’’

প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন নাবার্ডের জেলা উন্নয়ন আধিকারিক সুমর্ত্য ঘোষ, সংস্থার সম্পাদক পূর্ণেন্দু গড়াই-সহ বহু বিশিষ্ট মানুষজন।

সুমন্তবাবু বলেন, ‘‘ঘুড়ি উড়ানোর প্রতিযোগিতা বেশ উপভোগ্য।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন