নোট বাতিলে হিমেও কাত মদের ব্যবসা

এক দিকে নোট বাতিলের ধাক্কা, অন্যদিকে দর বেশ কিছুটা বেড়ে যাওয়া— এই জোড়া ধাক্কায় এ বার মদ ব্যবসায় লোকসানের আশঙ্কা ছিলই। হলও তাই! মাথায় হাত পড়েছে দুই জেলার মদ ব্যবসায়ীদের।

Advertisement

নিজস্ব সংবাদদাতা

বাঁকুড়া ও পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ২৫ নভেম্বর ২০১৬ ০০:৫৮
Share:

এক দিকে নোট বাতিলের ধাক্কা, অন্যদিকে দর বেশ কিছুটা বেড়ে যাওয়া— এই জোড়া ধাক্কায় এ বার মদ ব্যবসায় লোকসানের আশঙ্কা ছিলই। হলও তাই! মাথায় হাত পড়েছে দুই জেলার মদ ব্যবসায়ীদের। আর এর জেরে রাজস্বেও যে ব্যাপক ঘাটতি দেখা যাবে, তা কার্যত নিশ্চিত হয়ে গিয়েছেন আবগারি দফতরের কর্তারাও।

Advertisement

বাতাসে ঠান্ডা হাওয়ার ছোবল। কিন্তু নোট অচলের জেরে টান পড়েছে নেশাতে। নেশাড়ুদেরও কাটছাঁট করতে হয়েছে সান্ধ্যকালীন বাজেট। বিকেল গড়ালেই যাঁদের মন আনচান করতে থাকে, তাঁদের পকেটও খুচরোর অভাবে প্রায় গড়ের মাঠ। সংসার খরচ সামলে যাঁরা মাঝেমাঝেই পানশালামুখো হতেন, তাঁদের অনেককেই বন্ধুবান্ধব জুটিয়ে ‘জয়েন্ট ভেঞ্চারে’ নামতে হচ্ছে।

বাঁকুড়া শহরের নুনগোলা রোড এলাকার এক যুবকের আক্ষেপ, “হাতে নগদ টাকার বড়ই অভাব। ব্যাঙ্কে টাকা তোলাও কার্যত যুদ্ধ করার সামিল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই পরিস্থিতিতে যতটা খুচরো টাকা হাতে এসেছে তা যথা সম্ভব কম খরচ করছি।” তিনি জানাচ্ছেন, এই অবস্থায় আপাতত পকেটের টাকা খরচ করে মদ খাওয়ায় বাধ্য হয়েই ইতি টেনেছেন তিনি। বাঁকুড়া শহরের কালীতলা এলাকার এক যুবকের বক্তব্য, “কিছু বাতিল হওয়া নোট হাতে ছিল। মদের দোকানে সেগুলি চালিয়ে নিয়েছি। তার পর থেকে নগদের অভাবে আর দোকানমুখো হইনি।”

Advertisement

শীতের মুখে সুরারসিকদের এই মনোভাবের আঁচ পড়েছে মদ বিক্রেতাদের ক্যাশবাক্সে। বাঁকুড়া জেলার অন্যতম বিলাতি মদের ডিস্ট্রিবিউটর বিষ্ণুপুরের ময়রাপুকুর এলাকার বাসিন্দা শঙ্কর চৌধুরী বলেন, ‘‘মাসে অন্তত পাঁচ থেকে আট কোটি টাকার ব্যবসা করি। নোট বাতিলের সিদ্ধান্ত ঘোষণা হওয়ার পর থেকে এখনও ৫০ লক্ষ টাকার ব্যবসাও করতে পারিনি।’’ তিনি জানান,বাঁকুড়া ছাড়াও আশপাশের কয়েকটি জেলায় তাঁর ব্যবসা ছড়িয়ে রয়েছে। সর্বত্রই বিক্রি একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। ক্রেতা নেই, দোকানে মাছি তাড়াচ্ছেন কর্মীরা। এই চিত্রই বোঝাচ্ছে পরিস্থিতি কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে।

বাঁকুড়া শহরের নতুনগঞ্জ এলাকার একটি বিলাতি মদের দোকানের মালিক সুশোভন কুণ্ডুর কথায়, ‘‘যেখানে দৈনিক প্রায় ৬০ হাজার টাকার ব্যবসা হতো, সেখানে এখন মেরেকেটে ৩০ হাজার টাকার ব্যবসাও হচ্ছে না।’’ তিনি জানান, মদের দাম সম্প্রতি ১৬-২০ শতাংশ বেড়ে গিয়েছে। একে মানুষের হাতে নগদ টাকা নেই, তার উপর আবার দর বেড়ে যাওয়া। ব্যবসা এক ধাক্কায় এতটা কমে যাওয়ায় মাথায় হাত পড়েছে মদ ব্যবসায়ীদের।

একই কথা জানাচ্ছেন, বিষ্ণুপুরের ব্যবসায়ীরাও। শহরের একটি বেশ জমজমাট বিলাতি মদের দোকানের মালিক বলেন, “পুজো মরসুমে চুটিয়ে ব্যবসা হয়েছিলাম। কিন্তু তার রেশ কাটতে না কাটতেই এতবড় ধাক্কা খাব ভাবিনি। দোকানের কর্মীদের বেতন দেওয়ার টাকাও এখন উঠছে না।’’

নোট বাতিলের পরে ব্যবসা যে মার খাবে, তা আঁচ করেই প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত ঘোষণা হওয়ার পর প্রথম কয়েক দিন বাতিল নোটও নিচ্ছিলেন কিছু মদ বিক্রেতা। তাতে কিছুটা হলেও ব্যবসা খানিক চলছিল। তবে খুচরোর সমস্যা দেখা দেওয়ায় কিছু দিন পর থেকেই সেই নোট নেওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হন তাঁরা। বাঁকুড়া শহরের এক ব্যবসায়ীর কথায়, “সকলেই বাতিল নোট মদের দোকানে চালিয়ে নেওয়ার উদ্দেশ্যে আসছিলেন। তবে আমাদের খুচরোর সমস্যা দেখা দেওয়ায় বাতিল নোট নেওয়া বন্ধ করতে বাধ্য হলাম।”

হুড়া নিমতলা মোড়ের ব্যবসায়ী শ্রীকান্ত খাঁর কথায়, ‘‘নোট বাতিলের চোট সামলানোই দায়। বিক্রি অর্ধেক কমে গিয়েছে। প্রথম দিকে বাতিল নোট নিচ্ছিলাম। কিন্তু ব্যাঙ্ক এখন নিতে চাইছে না। তাই আমরাও ক্রেতাদের বাতিল নোটে মাল দিচ্ছি না।’’ একই সমস্যার কথা শুনিয়েছেন বান্দোয়ানের ব্যবসায়ী বিষ্ণু মাহাতো থেকে কাশীপুরের দোকানদার সমরেশ গোস্বামী, হুড়ার লক্ষ্ণণপুরের দোকানদার প্রদীপ মণ্ডল।

বাঁকুড়া জেলা আবগারি দফতরের এক কর্তার কথায়, “এর প্রভাব রাজস্বে কতদূর পড়ল, তা আগামী মাসের প্রথম সপ্তাহ ছাড়া বোঝা যাবে না। তবে আমাদের কাছে যা রিপোর্ট, তাতে বিক্রিবাটা একেবারেই মুখ থুবড়ে পড়েছে।” পুরুলিয়া জেলা আবগারি দফতরের সুপারিন্টেডেন্ট সিদ্ধার্থ সেন বলেন, ‘‘বাজার তো ভাল যাচ্ছে না। নোটের ধাক্কা পড়েছে কি না, সেটা মাসের শেষে হিসেব দেখলে বোঝা যাবে।’’

তবে এই পরিস্থিতিতেও সাধারণ মানুষকে কিছুটা রেহাই দিয়েছে ডেবিট বা ক্রেডিট কার্ড। বাঁকুড়া শহরের একটি প্রথমশ্রেণির হোটেল কাম বারের অন্যতম কর্ণধার প্রসেনজিৎ দত্ত বলেন, “ব্যবসা অনেকটাই ধাক্কা খাবে বলে আশঙ্কা করেছিলাম। নোট বাতিলের পর কয়েকটা দিন ব্যবসা কিছুটা ঝিমোচ্ছিল। তবে আমাদের পানশালায় যেহেতু কার্ডে বিল মেটানোর সুযোগ রয়েছে, তাই ব্যবসায় বড় লোকসান অনেকটাই এড়ানো গিয়েছে।” বাঁকুড়া মেডিক্যালের এক ডাক্তারি ছাত্রের কথায়, “যা পরিস্থিতি তাতে নগদ টাকা দিয়ে মনোরঞ্জন করা বেশ চাপের। তাই যেখানে কার্ড চলে, বন্ধুরা মিলে সেখানেই যাচ্ছি।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন