দিন-বদল

বিরোধী নেই, হিংসার সেই দিন তাই অতীত

২০১৪-র লোকসভা ভোট শেষ। বিজেপি নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে ক্ষমতায় এসেছে। এমনই এক আবহে বীরভূমের পাড়ুই নামের তল্লাটে মাথা তুলতে শুরু করে পদ্মফুল। শুরু হয় বিজেপি-তৃণমূল রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। আর এক লোকসভা নির্বাচনের মুখে সেই পাড়ুইয়ের রাজনৈতিক সমীকরণ এখন কেমন, সরেজমিন খোঁজ নিল আন্দবাজার। রাজনৈতিক সন্ত্রাসের জেরে একটা সময় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল পাড়ুই থানা এলাকার জনজীবন। 

Advertisement

বাসুদেব ঘোষ

পাড়ুই শেষ আপডেট: ১৫ এপ্রিল ২০১৯ ০২:০৪
Share:

আপাত চোখে পাড়ুই এখন শান্তই। ছবি: বিশ্বজিৎ রায়চৌধুরী

যে পাড়ুইয়ে এক দিন কান পাতলেই শোনা যেত বোমা-গুলির শব্দ, সেই পাড়ুই আজ কেমন আছে?

Advertisement

এক কথায় বলা যায়, শান্ত। রাজনীতি আছে। কিন্তু, বিরোধী পরিসর কার্যত না থাকায় পাঁচ বছর আগের সেই হিংসার দিনগুলি আর ফেরেনি। রাজনৈতিক সন্ত্রাসের জেরে একটা সময় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল পাড়ুই থানা এলাকার জনজীবন। মানুষ ভয়ে বাড়ি থেকে বেরোতে পারতেন না, গ্রামের পর গ্রাম ছেড়ে পালিয়েছিলেন মহিলা-পুরুষ-শিশু-বয়স্কেরা। সেই পাড়ুই আজ অনেকটাই স্বাভাবিক ছন্দে। এলাকার বিজেপি নেতা শেখ সামাদ যতই দাবি করুন, পাড়ুইয়ে তাঁদের সংগঠন বাড়ছে, এলাকার বাসিন্দারা কিন্তু জানিয়ে দিচ্ছেন, পাড়ুই শান্ত থাকার প্রধান কারণ কোনও বিরোধী না-থাকা!

ঠিক কতটা বিরোধী-শূন্য?

Advertisement

একটু পিছনে ফিরে দেখা যাক। ২০১৩ সালে পঞ্চায়েত নির্বাচনেই কসবা পঞ্চায়েতে বিক্ষুদ্ধ তৃণমূল কর্মীরা প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। অনুব্রত মণ্ডলের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর সঙ্গে সমানে টক্কর দিয়ে ১২ আসনের কসবা পঞ্চায়েতের ৬টি আসন ছিনিয়ে নেন বিক্ষুব্ধেরা। টসে জিতে নির্দলদের হাতেই কসবা পঞ্চায়েতের ক্ষমতা যায়। সেই সময় পঞ্চায়েতের প্রধান করা হয় বিক্ষুদ্ধ তৃণমূল নেতা নিমাই দাসের স্ত্রী শঙ্করী দাসকে। তিন বছর পর থেকেই হাওয়া ঘুরতে শুরু করল। যাঁরা বিজেপিতে এসেছিলেন, তাঁরা ঠিক করেন, দল যখন বিপদের দিনে পাশে দাঁড়ায়নি, তখন সেই দল আর করবেন না। তাঁদের একটা বিরাট অংশ ২০১৫ সালে ফের তৃণমূলে যোগদান করেন।

সব মিলিয়ে যে পাড়ুইয়ের হাত ধরে বিজেপি-র উত্থান হয়েছিল, সেখানেই তারা এক প্রকার ধরাশায়ী হয়ে পড়ে। ২০১৬ সালের বিধানসভা ভোটে পাড়ুই থানার আটটি অঞ্চলে একচেটিয়া ভোট করার অভিযোগ ওঠে তৃণমূলের বিরুদ্ধে।

ওই নির্বাচনের পরে পরেই দলবিরোধী কাজের অভিযোগ তুলে কসবার পঞ্চায়েত প্রধান শঙ্করী দাসের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনা হয়। ১১-০ ভোটে পরাজিত হন তিনি। এর পর থেকে পার্টিতে আর সেই ভাবে দেখা যায় না নিমাই দাসকে। ২০১৮-র পঞ্চায়েত নির্বাচনে গোটা বোলপুর মহকুমাতেই কার্যত কোনও ভোট হয়নি। পাড়ুই এলাকার ৮টি পঞ্চায়েতে এক জন বিরোধী প্রার্থীও মনোনয়ন জমা দিতে পারেননি। লোকসভা ভোটেও পাড়ুইয়ে এখন একটাই দল, একটাই প্রতীক।

সেই সময় বিজেপিতে চলে যাওয়া স্থানীয় তৃণমূল নেতা বিকাশ মণ্ডল বলছিলেন, ‘‘বিজেপিতে যোগ দেওয়া আমাদের ভুল হয়েছিল। সেই সময় দুধকুমার মণ্ডকে জেলা সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় এবং তার পরেই তিনি বলেন আমি রাজনীতি থেকে সন্যাস নিচ্ছি। ফলে আমাদের পাশে এসে কোন নেতা দাঁড়াননি।’’ বিজেপি ছেড়ে তৃণমূলে ফেরা মকবুল খানও বলেন, ‘‘সেই সময় বিজেপিতে গিয়ে আখেরে আমাদের ক্ষতিই হয়েছে। যাদের হয়ে লড়াই করেছিলাম, সেই নেতৃত্বকে পাশে পাইনি আমরা। উল্টে মিথ্যা মামলায় আমাদের অনেক জনকে সেই সময় আসামি করা হয়েছিল।’’

লোকসভা ভোটে আবার পাড়ুই অশান্ত হয়ে উঠবে না তো?

এলাকার বাসিন্দারা কিন্তু সেই আশঙ্কা আর করছেন না। পাড়ুই গ্রামের বাসিন্দা চিন্ময় ঘোষ, পরেশ মণ্ডলদের কথায়, ‘‘সেই সময় এক অন্য পাড়ুই ছিল। আর আজ অন্য পাড়ুই। সেই সময় প্রাণ হাতে করে আমাদের কাজে বেরোতে হত। আজ সেই ভয়টা নেই।’’

বীরভূম লোকসভা কেন্দ্রের বিজেপি প্রার্থী দুধকুমার নিজেই বলছেন, ‘‘সেই সময়ে এক প্রেক্ষাপট ছিল। এখন আর এক।’’ এখন কেন পাড়ুইয়ে বিজেপি-র সংগঠনের এই হাল, সে প্রশ্নে তাঁর কৌশলী জবাব, ‘‘যাঁরা জেলার দায়িত্বে আছেন, তাঁরাই বলতে পারবেন, পাড়ুইয়ে এখন কেন বিজেপি-র সংগঠন নেই। আমি পার্টির তরফে এক জন প্রার্থী মাত্র। এ বিষয়ে কিছু বলতে পারব না।’’ বিজেপি-র বর্তমান সভাপতি রামকৃষ্ণ রায়ের আবার বক্তব্য, ‘‘সেই সময় কিছু লোক মাথা বাঁচানোর জন্য বিজেপিতে এসেছিল। আমাদেরও ভুল হয়েছিল তাঁদেরকে দলে নেওয়া।’’ পাড়ুইয়ে আর দলের নেতানেত্রীদের কেন দেখা পাওয়া গেল না প্রশ্নে তাঁর জবাব, ‘‘সেই সময় এক বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তাই রাজ্য নেতৃত্ব বারবার ছুটে এসেছিলেন পাড়ুইয়ে। তার পর থেকে আর কোনও বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হয়নি, তাই তাঁরা আসেননি।’’

জেলা পরিষদের সভাধিপতি তথা তৃণমূল নেতা বিকাশ রায় চৌধুরীর কটাক্ষ, ‘‘শুধুমাত্র রাজনীতি করার জন্যই সেই সময় মাঠে নেমেছিল বিজেপি। তারা ঘোলা জলে মাছ ধরতে চেয়েছিল। কিন্তু তাতে তাদের লাভের লাভ কিছুই হয়নি। কারণ, পাড়ুইয়ের সাধারণ মানুষ তাদের সাথে নেই।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন