পুড়ে গিয়েছে শেখ কালোর আসবাব, খাট। বাড়ির দরজায় বোমার আঘাত। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত
একটি বাড়ি ঘিরে চলছে বোমাবাজি। বোমা ও গুলি দিয়েই হামলার জবাব আসছে সেই বাড়ির ভিতর থেকে। সোমবার রাত থেকে মঙ্গলবার ভোর পর্যন্ত এমনই বোমা-গুলির লড়াইয়ে কেঁপে উঠল খয়রাশোলের কাঁকরতলা থানার বড়রা গ্রাম। স্থানীয় বাসিন্দাদের বড় অংশই দাবি করছেন, পঞ্চায়েতের ক্ষমতা দখলকে ঘিরে শাসকদলেরই দুই গোষ্ঠী এলাকা এমন অশান্ত করে রেখেছে।
যে বাড়ি ঘিরে হামলা হয়েছে বলে অভিযোগ, সেটি বড়রা অঞ্চলের তৃণমূল নেতা শেখ কালোর। বড়রা গ্রামে তৃণমূল কার্যালয়ে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় মূল অভিযুক্ত সেই শেখ কালো ওরফে শেখ আজফার, তাঁর তিন ভাই ও সঙ্গীসাথীদের গ্রেফতার করছে পুলিশ। বীরভূমের পুলিশ সুপার আভারু রবীন্দ্রনাথ জানিয়েছেন, মোট ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। ধৃতদের কাছ থেকে ৫টি আগ্নেয়াস্ত্র, ৮টি বোমা এবং ২২ রাউন্ড কার্তুজ পাওয়া গিয়েছে। পুলিশ গোটা ঘটনার তদন্ত করছে।
শেখ কালোর পরিবারের লোকেরা আবার অভিযোগ করছেন, খয়রাশোলের তৃণমূল নেতা উজ্জ্বল হক কাদেরির নির্দেশে এবং বড়রা পঞ্চায়েতের তৃণমূল সদস্য শেখ আব্বাসদের নেতৃত্বে তাঁদের বাড়ি ঘিরে হামলা চালায় বহু লোক। যদিও এই মর্মে লিখিত কোনও অভিযোগ মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত থানায় দায়ের হয়নি। অভিযোগের প্রতিক্রিয়ায় উজ্জ্বল হক কাদেরির দাবি, ‘‘আমি তো এলাকাতেই ছিলাম না! শুনেছি দু’দিন আগে ১০০ দিনের টাকার ভাগ চাইতে পঞ্চায়েত সদস্য শেখ আব্বাসের বাড়িতে চড়াও হয়েছিল কালো ও তার দলবল। সোমবার রাতেও ওরা আব্বাসের বাড়ি আক্রমণ করে।’’ তাঁর আরও দাবি, ‘‘বহিরাগতদের নিয়ে এসে কালো ও তার দলবল এলাকায় অশান্তির ছক করেছিল। এতদিন ধরে এলাকায় এত অন্যায় করেছিল কালো। যা হয়েছে সব জনরোষে।’’
দিল্লি দখলের লড়াই, লোকসভা নির্বাচন ২০১৯
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছরে ১০০ দিনের প্রকল্পের কাজ নিয়ে আব্বাস-গোষ্ঠী ও কালো-গোষ্ঠীর মধ্যে সংঘাত শুরু হয়েছিল। তারপর থেকে দু’পক্ষই প্রস্তুত ছিল। সেটাই চরম আকার নেয় মনঙ্গলবার কাকভোরে। ভোর তিনটে থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত টানা গুলি-বোমার লড়াই চলে। আতঙ্ক ছড়ায় গোটা এলাকায়। গ্রামবাসীরা বলছেন, বোমা-গুলির কানফাটানো আওয়াজে তীব্র আতঙ্ক ছড়ায়। সবাই যে যাঁর বাড়ির দরজা-জানলা বন্ধ করে ভিতরে বসেছিলেন। পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, কালোর বাড়ির ভিতর থেকে হামলার পাল্টা জবাব দেওয়া হয়েছে টানা। হামলাকারীরা চেষ্টা করেও কালোর বাড়ির দু’টি পোক্ত লোহার দরজা ভাঙতে পারেনি। যে হারে বোমাগুলি চলছে তাতে প্রাণহানিও হতে পারত বলে এলাকাবাসী জানিয়েছেন। সকালে পুলিশ এসে পৌঁছে যাওয়ায় সেটা এড়ানো গিয়েছে।
মঙ্গলবার সকালে কালোর বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, গোটা বাড়ির দেওয়ালে, জানলায়, দরজায় বোমার চিহ্ন। বহু চেষ্টা করা হয়েছে লোহার দরজা-জানলা ভাঙার। বোমার আঘাতে বেঁকে গিয়েছে জানলা। কালোর পরিবারের দাবি, পেট্রেল ঢেলে আগুন লাগানোর চেষ্টা হয়েছিল বাড়িতে। আতঙ্কিত মহিলা ও শিশুরা। কালোর ভাইয়ের স্ত্রীরা এবং মা লছমনা বিবি বলছেন, ‘‘দরজা ভেঙে ফেললে আমাদের সবাইকে মেরেই ফেলত ওরা! কোনও রকমে প্রাণে বেঁচেছি। অথচ তার পরেও আমাদের বাড়ির ছেলেদের তুলে নিয়ে গেল পুলিশ।’’
পুলিশ জানিয়েছে, প্রথমে কালো, তাঁর ভাই ও সঙ্গীসাথীদের বাড়ি থেকে উদ্ধার করা হয়। পরে বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে অস্ত্র উদ্ধার হওয়া পরে জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে কালো-সহ ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু, কেন এই সংঘাত?
তৃণমূল সূত্রেই জানা যাচ্ছে, গত পঞ্চায়েত নির্বাচনের সময় দলের হয়ে মূল নিয়ন্ত্রেকের ভূমিকায় ছিলেন শেখ আজফার ওরফে কালো। খয়রাশোলের নিহত ব্লক তৃণমূল সভাপতি দীপক ঘোষের অনুগামী বলে পরিচিত কালোর দাপটে কোণঠাসা ছিলেন বিরুদ্ধ গোষ্ঠীর নেতা উজ্জ্বল হক কাদেরি। বিরোধী শূন্য বড়রা পঞ্চায়েতের চার জন সদস্যও কালোর অনুগামী বলে চর্চা ছিল। পরিস্থিতি বদল হত শুরু করে গত বছর সেপ্টেম্বরে কালোর দখলে থাকা বড়রা অঞ্চল কার্যালয়ে বিস্ফোরণের ঘটনার পর থেকে। পুলিশের করা স্বতঃপ্রণোদিত বিস্ফোরণ মামলায় প্রথমেই নাম ছিল কালো ও তাঁর ঘনিষ্ঠদের। পুলিশের উপর হামলা চালানোর মামলাতেও নাম ছিল কালোর। পুলিশের খাতায় ‘ওয়ান্টেড’ কালো গ্রেফতারি এড়াতে দীর্ঘদিন গা ঢাকা দিয়েছিলেন। তবে এলাকায় কোথাও একটা তাঁর নিয়ন্ত্রণ ছিল। জানুয়ারিতে উজ্জ্বল হক কাদেরি গ্রেফতার হওয়ার পর থেকে সেটা আরও বাড়ে।কিন্তু লোকসভা ভোটের মুখে উজ্জ্বল জামিন পেতেই ছবিটা বদলায়। উজ্জ্বল-গোষ্ঠীর প্রভাব বাড়তে শুরু করে এলাকায়। এমনকি, এক সময় আজফার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিত শেখ আব্বাসও যোগ দেন কাদেরির শিবিরে। তৃণমূলের একটি সূত্র বলছে, এলাকায় হারানো জমি ফিরে পেতে দিন কয়েক মরিয়া হয়ে দিন কয়েক আগে বাড়ি ফেরেন কালো ওরফে আজফার। তার পরেই কিছু একটা হতে পারে বলে আঁচ করছেন এলাকার মানুষ।
এই ঘটনায় অস্বস্তি বেড়েছে তৃণমূলে। খয়রাশোল ব্লকে দলীয় পর্যবেক্ষক তথা জেলা সভাধিপতি বিকাশ রায়চৌধুরী বলেন, ‘‘ঘটনা যাই ঘটুক, পুলিশকে বলেছি নিরপেক্ষ তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে।’’