শোকের ছায়া। নিজস্ব চিত্র
কুড়ি দিন পরেই ছিল জন্মদিন। তার আগেই মণিপুরি নৃত্যগুরু কাব্রাবাম যতীন্দ্র সিংহ, শান্তিনিকেতনের ‘জিতেনদা’ মঙ্গলবার ভোররাতে শান্তিনিকেতন অবনপল্লির বাড়িতে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। দীর্ঘ দিন ক্যানসারে ভুগছিলেন। ফেব্রুয়ারি মাস থেকে সমস্যা বাড়ে। এর মাঝেই দু’বার শান্তিনিকেতন পিয়ার্সন মেমোরিয়ালে ভর্তি করাতে হয় তাঁকে। জিতেনদার মৃত্যুতে শোকের ছায়া শান্তিনিকেতনে। মঙ্গলবার কালিসায়র শ্মশানে তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন করেন ছেলে শুভজিৎ সিংহ। সহকর্মী, সহশিল্পী থেকে শুরু করে ছাত্রছাত্রীরা শোক জানিয়েছেন। তাঁর মৃত্যুতে মণিপুরি নৃত্যের জগতে একটি যুগের অবসান হল।
জিতেনবাবু মণিপুরের এক প্রত্যন্ত গ্রামে ১৯৪৫ সালের ২২ এপ্রিল জন্মগ্রহণ করেন। দিল্লি থেকে ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়ে শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন ১৯৬৫ সালে। জেদ ছিল শান্তিনিকেতনে পড়বেন। শুধু পড়বেন তাই-ই নয়। বাংলা ভাষাতেই পড়বেন। সেই মতো তাঁর থাকার ব্যবস্থা হয় সঙ্গীতভবনের কদমতলা ছাত্রাবাসে। যেখানে কিনা আলাউদ্দিন খাঁ সাহেব নাতি আশিসকে নিয়ে থেকেছেন, বিলায়েত খান থেকেছেন। শুরুটা সেই থেকেই। তার পরে কেটে গিয়েছে এতগুলো বছর। শান্তিনিকেতনকে ভালবেসে ফেলেছিলেন তিনি।
জিতেনবাবুর অত্যন্ত কাছের মানুষ ছিলেন নাট্যশিল্পী সলিল সরকার। তিনি বললেন, ‘‘মানুষটা কেন জানি না আমাকে খুব ভালবাসতেন। জীবনের অনেক কথা বলেছিলেন।’’ তাঁর কাছ থেকেই জিতেনবাবু সম্পর্কে জানা গেল অনেক তথ্য। যে ন্যাশনাল স্কলারশিপ পেয়ে তিনি শান্তিনিকেতনে পড়তে এসেছিলেন, তার মেয়াদ যখন ফুরিয়ে গেল, তখন দিনরাত একটাই চিন্তা শান্তিনিকেতনের মায়া কাটাবেন কী করে? ঠিক তখনই এক দিন শান্তিদেব ঘোষ জিতেনবাবুকে একটা কাগজ এগিয়ে দিয়ে নাকি বলেছিলেন, ‘যতীন এখানে একটা সই করে দাও তো দেখি।’
কোনও প্রশ্ন না করেই সেই কাগজে সই করে দিয়েছিলেন তিনি। তার পরে তাঁর স্মৃতিকথায় বলেন, ‘‘শান্তিদা বললেন, যতীন তুমি কাল থেকে পাঠভবনের ক্লাস নেবে। মাসের শেষে ওই শান্তিদাই হাতে দু’শো পঁচিশ টাকা দিয়ে বললেন এটা এখন থেকে তোমার মাইনে।’’ তার পর থেকেই শান্তিনিকেতনে থেকে গেলেন জিতেন সিংহ। শান্তিদেব ঘোষ যাঁকে ডাকতেন যতীন নামে। তখন থেকেই বসন্তোৎসব হোক বা শারদোৎসব, ‘মায়ার খেলা’ কিংবা ‘চণ্ডালিকা’, ‘ভানুসিংহের পদাবলী’ কি ‘রাসলীলা’ সবখানেই জিতেনবাবু। পাঠভবনের পরে সঙ্গীতভবনে অধ্যাপনা করেন। পরে ভবনের অধ্যক্ষও হন। মণিপুরী নৃত্যের প্রদর্শনে দেশবিদেশে গিয়েছেন।
সঙ্গীতভবনের অধ্যাপিকা স্বস্তিকা মুখোপাধ্যায় পাঠভবনের ছাত্রী থাকাকালীন নাচ শিখেছিলেন জিতেনবাবুর কাছে। তিনি বলেন, ‘‘অধ্যক্ষ থাকাকালীন শান্তিনিকেতন বসন্ত উৎসব জিতেনদাকে ছাড়া ভাবাই যেত না। ওঁনার অবসরের পরে উৎসবের কী হবে নিয়ে ভাবতে বসেছিলাম। ভীষণ পরিশ্রমী আর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন মানুষ ছিলেন তিনি।’’ স্মৃতিচারণায় ফিরে গিয়েছেন বিশ্বভারতীর ভারপ্রাপ্ত উপাচার্য সবুজকলি সেনও। তিনি বললেন, ‘‘ছাত্রীজীবনের প্রথম থেকেই ওঁনার গুণমুগ্ধ ছিলাম। নির্বিরোধী মানুষ ছিলেন। অনেক শিল্পী ও ছাত্রকে তিনি নিজের হাতে তৈরি করেছেন। ওঁনার চলে যাওয়ায় অপূরণীয় ক্ষতি হল।’’