২৮ বছর পরে হঠাৎ ফিরলেন সুবীর

হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া মানুষটাকে যখন ভুলতে বসেছে সবাই, সেই সময়েই নিজের স্মৃতি ফিরে পেয়ে বাড়ির সদর দরজা ঠেলে আঙিনায় ঢুকলেন ছাতনার সরবেড়িয়া এলাকার বছর পঁয়ষট্টির সুবীর কর্মকার।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

ছাতনা শেষ আপডেট: ০৬ মার্চ ২০১৮ ০০:০০
Share:

পরিচয়: স্বামীর কোলে নাতনিকে তুলে দিচ্ছেন ঊর্মিলাদেবী। নিজস্ব চিত্র

ছেলেদের দেখেছিলেন, টলমল পায়ে হাঁটতে। ২৮ বছর পরে বাড়ি ফিরে দেখেন, তাঁরাই যুবক। নাতনিরাই এখন টলমল পায়ে হাঁটছে। আদ্যন্ত বদলে গিয়েছে চারপাশ। হঠাৎ করে নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া মানুষটাকে যখন ভুলতে বসেছে সবাই, সেই সময়েই নিজের স্মৃতি ফিরে পেয়ে বাড়ির সদর দরজা ঠেলে আঙিনায় ঢুকলেন ছাতনার সরবেড়িয়া এলাকার বছর পঁয়ষট্টির সুবীর কর্মকার।

Advertisement

তাঁকে ঘিরে উচ্ছ্বাস শুধু পরিবারের নয়, তা ছুঁয়ে গেল গোটা গ্রামকে। গ্রাম উজিয়ে লোক দেখতে আসছেন বছর পঁয়ষট্টির সুবীর কর্মকারকে। আসছেন বাল্যকালের বন্ধুরাও। গ্রামের চা দোকান থেকে পরিবারের অন্দরমহল— সর্বত্রই চর্চা সুবীরবাবুর ফিরে আসা নিয়ে।

কী ভাবে নিখোঁজ হয়েছিলেন সুবীরবাবু? তাঁর স্ত্রী ঊর্মিলাদেবী জানান, সুবীরবাবু মানসিক ভাবে অসুস্থ ছিলেন। তাঁদের বিয়ের বছর সাতেক পরে নিখোঁজ হয়ে যান। সেই সময় এই দম্পতির বড় ছেলে শান্তির বয়স ছিল পাঁচ বছর ও ছোট ছেলে সন্তোষ ছিল তিন বছরের। ঘটনার দিন সুবীরবাবু বাঁকুড়া শহরে বোনের বাড়িতে গিয়েছিলেন। সেখান থেকে বাসে চড়ে দুর্গাপুরে দিদির বাড়িতে যাওয়ার জন্য বের হন। তারপর থেকেই আর কোনও হদিস মেলেনি তাঁর।

Advertisement

ঊর্মিলাদেবী বলেন, “স্বামী নিরুদ্দেশ হওয়ার পরে খুবই সমস্যায় পড়ি। দু’ই সন্তানকে কী ভাবে মানুষ করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। থানায় গিয়েছিলাম। পুলিশ মুখের উপরে বলে দিয়েছিল, গরু হারিয়ে গেলে খুঁজে দিতে পারব, কিন্তু মানুষ খুঁজতে পারব না। এরপর আমাদের আর কিছু করার ছিল না।” তিনি জানান, লোকের বাড়িতে কাজ করে দুই ছেলেকে বড় করেছেন তিনি। শান্তি ও সন্তোষ এখন ছাতনা সুপার স্পেশ্যালিটি হাসপাতালে কাজ করেন। দু’জনেই বিয়ে করেছেন। শান্তির দুই মেয়ে। সন্তোষের একটি মেয়ে।

কী ভাবে খোঁজ মিলল তাঁরা। পরিবারের লোকজন জানাচ্ছেন, মুম্বইয়ের একটি বেসরকারি সংস্থাই সুবীরবাবুকে উদ্ধার করে রবিবার বাড়িতে দিয়ে যান। ওই সংস্থা ভবঘুরেদের পুনর্বাসন ও চিকিৎসা করানোর কাজ করে থাকে।

সংস্থার অন্যতম সদস্য ইজহার জামান বলেন, “তিন বছর আগে রাজস্থানের জোধপুরের রাস্তায় উলঙ্গ অবস্থায় ঘুরে বেড়াতে দেখা গিয়েছিল সুবীরবাবুকে। সংস্থার কর্মীদের নজরে আসতে তাঁকে উদ্ধার করে রাজস্থানে আমাদের হেফাজতে রাখা হয়। ছ’মাস আগে তাঁকে মুম্বইয়ে আমাদের সংস্থার হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আনা হয়। সেখানে চিকিৎসায় স্মৃতি ফিরে পেয়ে তিনি নিজের পরিচয় জানিয়েছিলেন।’’

তিনি জানান, সুবীরবাবুর বলা ঠিকানা ইন্টারনেটে সার্চ করে যাচাই করে ওই সংস্থা। সুবীরবাবুর বলা তথ্য ইন্টারনেটে মিলে যাওয়ায় তাঁকে সরাসরি বাড়িতে নিয়ে আসেন সংস্থার সদস্যেরা।

রবিবার দুপুরে রোজকার মতোই বাড়িতে রান্নার কাজে ব্যস্ত ছিলেন ঊর্মিলাদেবী। হঠাৎই অপরিচিত লোকজনকে বাড়িতে ঢুকতে দেখে রান্না ঘর থেকে বের হয়ে আসেন। এতগুলো বছর হয়ে গেলেও সুবীরবাবুকে দেখেই চিনতে পারেন তিনি। স্বামীকে ফিরে পেয়ে আবেগে চিৎকার করে ওঠেন। ঊর্মিলাদেবী বলেন, “হঠাৎই যেন সব বদলে গেল। বছরের পর বছর ধরে নিজের মনে ধন্দ নিয়ে বেঁচেছি। কখনও ভাবতাম আর হয়তো কোনও দিনই মানুষটাকে দেখতে পাব না। আবার কখনও সখনও মন হলত, দেখা হবে। এই ক্ষীণ আশাটুকু নিয়েই বেঁচেছিলাম।। ভাবতেই পারিনি এই ভাবে একদিন হঠাৎ করে ফিরে আসবেন তিনি।’’

ঊর্মিলাদেবী যুক্ত করেন, “এই ধরনের ঘটনা টিভি সিরিয়ালে দেখেছি। বাস্তবেও যে এমন হয়, সেটা এ বার প্রমাণ হল।” স্বামীকে ফিরে পেয়ে নিজের নাতিনি দের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছিলেন ঊর্মিলাদেবী। সুবীরবাবু অবশ্য পুরনো দিনের বহু ঘটনাই মনে করতে পারছেন না। কী ভাবে তিনি নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন তাও মন থেকে মুছে গিয়েছে তাঁর।

ফেলে আসা জীবন মনে করাতে চান পড়শিরাও। সরবেড়িয়া মোড়ের চা দোকানি সৃষ্টিধর গড়াই ডুব দেন স্মৃতিতে। তিনি বলেন, “তখন আমি অনেক ছোট। সুবীরদার বাড়িতেই কামারশাল ছিল। সেখানে কাস্তে, বঁটি বানাতে দিতে যেতাম। হঠাৎই একদিন শুনলাম সুবীরদা নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছেন।” স্থানীয় বাসিন্দা সুবীরবাবুর ছোটবেলার বন্ধু সুনীল দত্ত বারবার তাঁকে জিজ্ঞেস করছিলেন “আমাকে চিনতে পারছিস?” তিনি বলেন, “এক সঙ্গে গ্রামের মাঠে খেলে বড় হয়েছি আমরা। ওকে যে আবার দেখতে পাব তা কল্পনাতেও ছিল না।”

কতটা বদলে গিয়েছে জীবন? সুবীরবাবু বলেন, “অনেক বদলে গিয়েছে। পুরনো দিনের সঙ্গে অনেক কিছুই মেলাতে পারছি না।”

তাঁর দাদা অমর কর্মকার বলেন, “ভাইকে ফিরে পেয়ে আমাদের সংসার যেন পূর্ণ হন। ওই বেসরকারি সংস্থার লোকজন আমাদের যে কত বড় উপকার করলেন, তা ভাষায় বোঝানো যাবে না।” স্থানীয় যুবক বিধান দত্ত বলেন, “ছোট থেকেই সুবীরকাকুর কী ভাবে হারিয়ে গেলেন সেই গল্প শুনে আসছি। তাঁকে ফিরে আসতে দেখে সেই গল্প যেন শেষ হল।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন