রক্তে ভাসছে জোড়া দেহ, টিভি চলছে

ঘরের সেন্টার টেবিলে ছড়িয়ে কাজু বরফি, ভুজিয়া। স্টিলের গ্লাসে জল। টিভি চললেও সে দিকে নজর নেই কারও। যাঁরা টিভি চালিয়েছিলেন, মেঝে ভেসে যাচ্ছিল তাঁদেরই রক্তে। বিছানায় পড়ে কর্তার দেহ, মেঝেতে গিন্নির। দু’জনেরই গলা কাটা, শরীরের একাধিক জায়গায় ধারালো অস্ত্রের কোপ।

Advertisement

প্রশান্ত পাল

পুরুলিয়া শেষ আপডেট: ১৩ জুন ২০১৬ ০৮:৩৬
Share:

পুরুলিয়ার নীলকুঠিডাঙায় সেই বাড়ি এখন তালাবন্ধ। ছবি: সুজিত মাহাতো।

ঘরের সেন্টার টেবিলে ছড়িয়ে কাজু বরফি, ভুজিয়া। স্টিলের গ্লাসে জল। টিভি চললেও সে দিকে নজর নেই কারও। যাঁরা টিভি চালিয়েছিলেন, মেঝে ভেসে যাচ্ছিল তাঁদেরই রক্তে। বিছানায় পড়ে কর্তার দেহ, মেঝেতে গিন্নির। দু’জনেরই গলা কাটা, শরীরের একাধিক জায়গায় ধারালো অস্ত্রের কোপ।

Advertisement

বৈশাখের তপ্ত সকালে পুরুলিয়া শহরের নীলকুঠিডাঙা এলাকায় অলঙ্কার ব্যবসায়ীর বাড়ির দরজা খুলে এই দৃশ্য দেখে চোখ কপালে উঠেছিল পুলিশ কর্মীদের। শহরের বুকে এতবড় মাপের খুন সাম্প্রতিক কালে হয়নি। কেন খুন হলেন এই বৃদ্ধ দম্পত্তি? কারাই বা তাঁদের খুন করলেন? কী তাদের উদ্দেশ্য? পর পর প্রশ্ন সামনে এলেও উত্তর জানা ছিল না কারও।

কলকাতা বা শহরতলিতেই বয়স্কদের সম্পত্তি দখর করা-সহ নানা কারণে আততায়ীরা টার্গেট করে। তাহলে কি এ বার পুরুলিয়ার মতো প্রত্যান্ত জেলার শহরের বয়স্করাও কি তবে আর নিরাপদ নয়? প্রশ্নের মুখে পড়ে যায় পুরুলিয়া পুলিশের ভূমিকা।

Advertisement

খুনের ঘটনাটি ঘটেছিল ২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল রাতে। পরের দিন সকাল পর্যন্ত তাঁদের ফোনে না পেয়ে এক আত্মীয় পুরুলিয়া সদর থানার পুলিশকে ঘটনাটি জানান। তারপরেই পুলিশ নীলকুঠিডাঙার ওই বাড়িতে ঢোকে। তৎকালীন ডিএসপি (শৃঙ্খলা ও প্রশিক্ষণ) অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে তদন্তে নামে পুরুলিয়া পুলিশ।

প্রাথমিক ভাবে পুলিশের কাছেও রহস্য কিনারা করার মতো বিশেষ কিছু উপাদান ছিল না। খাবারের প্লেট, গ্লাস ও ঘরের বিভিন্ন জায়গা থেকে পুলিশ ফিঙ্গার প্রিন্ট জোগাড় করে। খতিয়ে দেখা হয় ব্যবসায়ীর ঘরে রাখা কিছু নথিপত্র। পড়শিদেরও জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। জেলা পুলিশের এক আধিকারিক জানিয়েছেন, ঘটনাস্থল থেকে তাঁরা সামান্য কিছু ক্লু পেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে আততায়ীকে সঙ্গে সঙ্গে চিহ্নিত করে ফেলার মতো উপাদান ছিল না।

তদন্তে নেমে পুলিশ জানতে পারে, নিহত ব্যবসায়ী রামশঙ্কর কোঠারি ও তাঁর স্ত্রী সুশীলা কোঠারির দুই ছেলে থাকলেও তাঁরা বাবা-মায়ের সঙ্গে বাস করেন না। পুরুলিয়ার বাইরে থাকেন। শহরের মধ্যবাজারে রামশঙ্করবাবুর সোনা-রুপোর দোকান রয়েছে। তবে শুধু ওটুকুই তাঁর ব্যবসা নয়। তিনি গয়না বন্ধক নিয়ে সুদে টাকা ধার দেওয়ার তেজারতি কারবারও পাশাপাশি চালাতেন।

ওই বৃদ্ধ দম্পতি এলাকার কারও সঙ্গে বিশেষ মেলামেশাও করতেন না। তাহলে ২০১২ সালের ২৮ এপ্রিল খুনের রাতে কাদের তাঁরা খাবার দিয়ে খাতির করেছিলেন? এই প্রশ্নই ভাবিয়ে তোলে তদন্তকারীদের। তবে কি আততায়ী নিহত দম্পতির পরিচিত কেউ? ওই ব্যবসায়ী সম্পর্কে খোঁজ করতে গিয়ে পুলিশের সন্দেহের তালিকায় উঠে আসে নিহতদের অতি ঘনিষ্ঠ একজন, দূর সম্পর্কের আত্মীয় পুরুলিয়া শহরেরই এক ব্যবসায়ী-সহ কয়েকজনের নাম। পুলিশ তাঁদের গতিবিধি সম্পর্কে‌ খোঁজ নেওয়া শুরু করে।

ইতিমধ্যে খুনের রাতে বৃদ্ধের খোয়া যাওয়া মোবাইল ফোনটি উদ্ধার করে পুলিশ। একজন গ্রেফতারও হন। পুলিশ কর্মীরা ভেবেছিলেন, তাঁরে ভালমতো জেরা করলেই কিনারা করা যাবে। কিন্তু বিস্তর জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ নিশ্চিত হয় ওই ব্যক্তি এই খুনের সঙ্গে কোনও ভাবেই যুক্ত নয়। তিনি ঘটনার পরের দিন সাহেববাঁধের পাড় থেকে মোবাইল ফোনটি কুড়িয়ে পেয়েছিলেন। পুলিশের মনে, একটা আশা তৈরি হয়, আততায়ী হয়তো সাহেববাঁধের পাড়ের রাস্তা ধরে খুন করে ফিরে গিয়েছিল।

কিন্তু তার বেশি আর বিশেষ কোনও অগ্রগতি হচ্ছিল না। এরই মধ্যে একদিন পুরুলিয়া সদর থানায় নিজের পাশপোর্টের পুলিশ ভেরিফিকেশন তাড়াতাড়ি সারতে তদ্বিরে আসেন পুলিশের সন্দেহের তালিকায় থাকা শহরের মার্বেল ব্যবসায়ী বিজয় অগ্রবাল। তাঁর বাড়ি দেশবন্ধু রোডে। নীলকুঠিডাঙা থেকে দেশবন্ধু রোডে যেতে সাহেববাঁধ হয়ে যাওয়া যায়। তিনি আবার নিহত ব্যবসায়ীর দূর সম্পর্কের ভাইপো। তাই পুলিশ কর্মীরা তাঁকে ওই ঘটনা সম্পর্কে থানাতেই জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন।

পুলিশ সূত্রের খবর, ঘটনার দিন বিজয় কোথায় কোথায় ছিলেন জানতে চাওয়া হলে সে পুলিশকে বলেছিল, ব্যবসার কাজে বোকারোয় গিয়েছিল। কিন্তু ততদিনে পুলিশের কাছে চলে এসেছিল, ঘটনার দিন সকালে তাঁর মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ছিল রাঁচিতে, সন্ধ্যা থেকে রাতে পুরুলিয়া শহরে এবং রাতে রাঁচিতে। বোকারোয় তাঁর মোবাইলের টাওয়ার লোকেশন ছিলই না। জেলার এক পুলিশ কর্তার দাবি, এই সব নথি নিয়ে চেপে ধরতেই বিনয় তাঁদের কাছে ভেঙে পড়েন। স্বীকার করেন, তিনি পরিকল্পনা করেই আরও দু’জনকে নিয়ে ওই বৃদ্ধ দম্পতিকে খুন করেছেন।

পুলিশের দাবি, বিজয় ব্যবসার জন্য স্ত্রীর গয়না রামশঙ্করবাবুর কাছে বন্ধক রেখে ৪৫ লক্ষ টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু সুদ নিয়মিত দিয়ে গেলেও রামশঙ্করবাবু টাকা ফেরত চেয়ে বিজয়কে চাপ দিচ্ছিলেন। এ দিকে স্ত্রীও গয়না ফেরত চেয়ে বিজয়বাবুকে তাড়া দিচ্ছিলেন। দু’তরফের চাপে শেষ পর্যন্ত গয়না ফেরত নিয়ে ওই ব্যবসায়ীকে খুনের পরিকল্পনা ফেঁদে ফেলেন বিজয়। তদন্ত করে এমনই দাবি পুলিশের।

পুলিশ জানাচ্ছে, বিজয়ের সঙ্গে সেই রাতে কোঠারি বাড়িতে গিয়েছিল তার ভাগ্নে নিশু ওরফে বিনীত অগ্রবাল এবং তার বন্ধু ধীরাজ অগ্রবাল। বিনীত ও ধীরাজ দিল্লিতে থাকে। তাদের দিল্লি থেকে বিমানে রাঁচিতে উড়িয়ে নিয়ে আসে বিজয়। ২৮ এপ্রিল সকালে নিজে গাড়ি নিয়ে রাঁচি থেকে ভাগ্নে ও ভাগ্নের বন্ধুকে পুরুলিয়ায় নিয়ে আসে বিজয়। ইতিমধ্যে রামশঙ্করবাবুকে বিজয় জানায়, সে টাকা মিটিয়ে দিতে চায়। এরপরেই সন্ধ্যায় দিল্লির দুই সঙ্গীকে নিয়ে বিনয় রামশঙ্করবাবুর বাড়িতে যায়। রামশঙ্করবাবু তাদের মতলব কী ঠাহর করতে না পেরে আপ্যায়ন করেন। বিজয় টাকা ফেরত দেবে ভেবে রামশঙ্করবাবু বন্ধক রাখা গয়না বের করেন। এরপরেই তিনজনে ওই বৃদ্ধ দম্পতিকে খুন করে। ফেরার পথে তারাই রামশঙ্করবাবু মোবাইলটি সাহেববাঁধের পাড়ে ফেলে যায়। সেই রাতেই নিশু ও ধীরাজকে দিল্লির উড়ানে তুলে দিতে রাঁচি যায় বিজয়।

বিজয়ের স্বীকারোক্তির পরে পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে। অভিজিৎবাবুর নেতৃত্বে এই কেসের তদন্তকারী অফিসার আদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায় ও অন্য পুলিশ কর্মীরা দিল্লিতে গিয়ে ক্যান্টনমেন্ট থানা থেকে নিশু ও ধীরাজকে খুনের ঘটনায় পাকড়াও করে। পুলিশ আদালতে ওই তিনজনের বিরুদ্ধে ঘটনার তিনমাসের মধ্যে চার্জশিট জমা দেয়। এখন শুনানি-পর্ব চলছে। বিজয়-সহ ধৃত তিনজনেই বর্তমানে গারদের ভিতরে। বিচারের অপেক্ষায় রয়েছে পুরুলিয়া।

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন