উৎসব: নবান্নের পুজোয়। ছবি: দয়াল সেনগুপ্ত
বাংলার কৃষিজীবী সমাজের সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী শস্যোৎসব নবান্ন। নতুন ধান ঘরে তোলার পরে সারা অগ্রহায়ণ মাস জুড়েই বিভিন্ন দিনে বাংলার ঘরে ঘরে এই উৎসব পালিত হয়।
তবে একই দিনে গোটা গ্রাম নবান্ন উৎসব করছে, এমন দৃশ্য খুব কমই দেখা যায়। ব্যতিক্রম ইলামবাজার ব্লকের টিকরবেতা গ্রাম। এখানে নবান্ন পালিত হয় এক সঙ্গে একই দিনে। অজয় নদের ধার ঘেঁষা এই গ্রামে দুর্গা, কালী, কার্তিক, সরস্বতী-সহ অন্য পুজো হলেও এই উৎসবকে ঘিরে জড়িয়ে রয়েছে ইতিহাস, ঐহিত্য ও সংস্কৃতি। অন্নপূর্ণা পুজো নামেই শতাব্দী প্রাচীন এই উৎসব এখনও তিন দিন ধরে ওই গ্রামে হয়। বুধবার ছিল সেই উৎসবের প্রথম দিন।
প্রায় হাজার চারেক বাসিন্দার ওই গ্রামের বাসিন্দাদের অধিকাংশের পেশা কাঁসা-পিতলের বাসন তৈরি। বাসিন্দাদের কথায়, বহু বছর ধরে নবান্ন উৎসবকে ঘিরে অন্নপূর্ণা উৎসব হয়ে আসছে। ছ’টি প্রতিমা হয়। সব ক’টিই বেশ প্রাচীন। জয়দেব-কেন্দুলির রাধাবিনোদ মন্দির থেকে মাত্র আধ কিলোমিটার দূরত্বের ওই গ্রামে বুধবার সকালে গিয়ে দেখা গেল উৎসবের আমেজ। চার দিকে সাজ সাজ রব।
গ্রাম ঢুকেই অশোক দাসদের অন্নপূর্ণা মন্দির। মন্দিরে প্রতিমা, আলপনা দেওয়ার কাজ প্রায় শেষ করে ফেলেছেন পরিবারের বধূ আল্পনাদেবী। গোঁসাই কর্মকারদের অন্নপূর্ণা মন্দির থেকে অজয় নদে পুজোর ঘট ভরতে গিয়েছেন পরিবারের সদস্যরা। প্রতিমা সাজানোর কাজ শেষে পুজোয় বসার তোড়জোড় চলছে গ্রামের দু’টি মেহতরি পরিবারের অন্নপূর্ণা মন্দিরে। মহিলারা কোথাও পুজোর থালা সাজাতে ব্যস্ত। একটি মেহতরি পরিবারের দাওয়ায় বসে নাতি-নাতিদের নবান্ন ও অন্নপূর্ণা পুজোর গল্প শোনাচ্ছেন বৃদ্ধ শুভঙ্কর মেহতরি। একটু তফাতে নবকুমার মণ্ডলদের মন্দিরেও পুজোর প্রস্তুতি তুঙ্গে। ধুনো গুঁড়ো করছিলেন পরিবারের বধূ মিতা মণ্ডল। প্রায় প্রতিটি অন্নপূর্ণা মন্দির ঘিরে ছোটখাটো ভিড়। ছোটরা ব্যস্ত আনন্দ করতে, বড়রা কাজে।
প্রস্তুতির ফাঁকেই পুজোর আয়োজকদের কাছে শোনা গেল, গ্রামে কবে অন্নপূর্ণা পুজো হবে তা নিয়ে গ্রামের সব ক’টি বাড়ির পুজোর উদ্যোক্তারা আগে একটি বৈঠক
করেন। এখন পরিবর্তিত এবং উন্নত প্রজাতির ধান চাষ করা হয়। ফসল আগেই ঘরে ওঠে। আগে ফসল উঠত ডিসেম্বরের ১৫ তারিখ। অগ্রহায়ণের শেষ ভাগে তাই পালিত হত নবান্ন। সেই সময় বেশ খানিকটা এগিয়ে এসেছে। গ্রামের বাসিন্দারা জানালেন, এমনিতে ছ’টি প্রতিমা হয়ে থাকে। তবে এ বার একটি অন্নপূর্ণা পুজো কিছু দিন পরে হবে। সেটা
সূত্রধরদের। কারণ, গ্রামের সব ক’টি প্রতিমা তাঁরাই বানান। বিয়ের মরসুম চলছে। ব্যস্ততা রয়েছে আসবাব বানানোরও। এই দুই চাপে অগ্রহায়ণের শেষই অন্নপূর্ণা পুজো হবে। এ কথা মানছেন তপন সূত্রধর, তারাপদ সূত্রধরেরাও।
পুজোর আয়োজন করে, সেই পরিবারগুলির মধ্যে অশোককুমার দাস, লতিকা দাস, কল্পনা রিনা মেহতরি, নিশিকান্ত মণ্ডলেরা জানিয়েছেন, সাবেক রীতি মেনেই এখনও দেবী অন্নপূর্ণার পুজো হয়। পুজো চলে তিন দিন। শুক্রবার সকালে পুজো শেষ। বিকেলে একসঙ্গে বিসর্জন।
প্রতিটি পরিবারের প্রতিমার গড়নও প্রায় একই রকমের। এক চালার মধ্যে শিব ও দুর্গা। তাঁদের দু’পাশে দেবরাজ ইন্দ্র ও দেবর্ষি নারদ। প্রসাদ বলতে আতপ চাল, নতুন ধানের চিঁড়ে, গুড়, ফল, মিষ্টি প্রভৃতি। প্রথম দিন অন্নপূর্ণার
পুজো দিয়ে প্রসাদ খাওয়ার চল বলে নবান্ন উৎসবের দ্বিতীয় দিন বাসি নবান্নেই আমেজ বেশি। গোটা গ্রামেই পালিত হয় নবান্ন। গ্রামের বাসিন্দাদের কথায়, কয়েক’টি পরিবারের হলেও নবান্ন উৎসব গ্রাম জুড়ে পালন করা হয়। বছরের অন্য দিন এই গ্রামে ঢুকলে কাঁসা-পিতল পিটিয়ে বাসন তৈরির শব্দ শোনা যায়। এ দিন সেই ধাতব শব্দ ছাপিয়ে গেল বিভিন্ন মণ্ডপ থেকে ঢাক, ঢোল, কাঁসর ও ঘণ্টার শব্দে। যুগ যুগ ধরে এ ভাবেই মেতে ওঠে অজয়-ঘেঁষা গ্রামটি।