কাপড়ে ফুল তুলে অনটনের সঙ্গে লড়াই

বছরচারেক আগের ঘটনা। নানুরের আটকুলা গ্রামের কাশ্মীরার বয়স তখন ২৩-এর আশপাশে। ১৪ মাসের সন্তান। আচমকা বিবাহবিচ্ছেদ হয় তাঁর। সন্তানকে নিয়ে ফিরতে হয় বাপের বাড়িতে।

Advertisement

অর্ঘ্য ঘোষ

নানুর শেষ আপডেট: ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮ ০১:০৮
Share:

সেলাই: নানুরের আলিগ্রামে। রবিবার। ছবি: কল্যাণ আচার্য

নুন আনতেই সব ফুরতো সেই সব পরিবারের। অনটন ছিল নিত্যসঙ্গী। ভাত-কাপড়ের অভাব থাকত বছরভর।

Advertisement

টানাটানির সংসারে এক দিন খড়কুটোর মতো আঁকড়ে ধরেছিলেন কাপড়ে ফুল তোলার কাজ। তাতেই হাসি ফিরেছে কাশ্মীরা খাতুন, মেম খাতুনের পরিবারে।

বছরচারেক আগের ঘটনা। নানুরের আটকুলা গ্রামের কাশ্মীরার বয়স তখন ২৩-এর আশপাশে। ১৪ মাসের সন্তান। আচমকা বিবাহবিচ্ছেদ হয় তাঁর। সন্তানকে নিয়ে ফিরতে হয় বাপের বাড়িতে। অভাবের সংসার সেখানে। দীর্ঘদিন আগে বাবা মারা গিয়েছেন। বাড়িতে অবিবাহিতা দুই বোন, বৃদ্ধা মা। কুলকিনারা পাচ্ছিলেন না কাশ্মীরা। টাকার অভাবে পড়াশোনা বেশিদূর করতে পারেননি। বিয়ের আগে মায়ের কাছে শিখেছিলেন কাঁথা স্টিচের কাজ। তারই ভরসায় এগোন কাশ্মীরা।

Advertisement

মহাজনের কাছ থেকে কাপড়, সুতো নিয়ে শুরু করেন ফুল তোলার কাজ। তা-ই এখন পথ বদলেছে ওই তরুণীর। কাশ্মীরা জানান, শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে আসার পর জীবনে অন্ধকার নেমে এসেছিল। সাহায্যের জন্য অনেক দরজার ঘুরে আশ্বাস ছাড়া কিছু মেলেনি। কাপড়ে ফুল তোলার ভাবনা আসে তখনই। তিনি বলেন, ‘‘শাড়িতে নকশা তুলে ছেলে আর আমার ভাত-কাপড়ের জোগাড় হয়ে যায়।’’

এক কথা বলছেন ওই গ্রামের আজিয়া বিবিও। এখন তাঁর বয়স ৫২। ২২ বছর আগে স্বামীকে হারিয়েছিলেন। বাপের বাড়িতে ঠাঁই হয় তারও। রয়েছেন বৃদ্ধা মা। তখন আজিয়া বিবির ‘পুঁজি’ ছিল মায়ের কাছে শেখা কাঁথা স্টিচই। তিনি বলেন, ‘‘কাপড়ে ফুল ফুটিয়েই এখন মা, মেয়ের কোনও রকমে চলে যায়।’’

কাশ্মীরারা জানান, একটি শাড়িতে ফুল তুলতে সময় লাগে গড়ে দেড় থেকে দু’মাস। মজুরি মেলে ১ হাজার ৮০০ থেকে দু’হাজার টাকা। এক থেকে দেড় মাস সময় লাগে একটি চাদরে নকশা তুলতে। মজুরি মেলে ১২০০-১৩০০ টাকা।

ওই টাকায় সংসার চলে? নিমড়ার ২১ বছরের মেম খাতুন বলেন, ‘‘কষ্ট করেও চালিয়ে নিতে হয়। কারও ভাতের জোগাড় হলে কাপড়ে টান পড়ে। আমাদের হাতের নকশায় সাজানো চাদর, কাপড়ে সাজেন অন্যরা। সাধ হলেও ওই শাড়ি পরার সাধ্য তো নেই আমাদের।’’ তিনি জানান, কাঁথা স্টিচের পাশাপাশি আরও টুকটাক কাজ করে সংসারের খরচ জোগাড় করেন। কাথা স্টিচের কাজে তো চোখের শক্তি লাগে অনেক— প্রশ্ন মাঝপথে থামিয়েই কাশ্মীরা বলেন, ‘‘দৃষ্টিশক্তি কমলে ফের পরের মুখের দিকে তাকাতে হবে আমাদের। তার আগে ছেলেটা বড় হয়ে গেলেই ভাল।’’

সরকারি ভর্তুকিতে ঋণ, বিপণনের সুবিধা মিললে শিল্পীরা আরও কিছুটা লাভের মুখ দেখতে পারেন বলে মনে করেন নানুরের লাভলি বিবি। পরিবারে আচমকা নেমে আসা বিপর্যয়ের ধাক্কা থেকে তাঁকেও বাঁচিয়েছে কাঁথা স্টিচই। এখন একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার সাহায্যে প্রায় ৭০ জন মহিলাকে মজুরির বিনিময়ে সুতো, কাপড় দিয়ে কাজ করান তিনি। তাঁর হিসেব, ১২০০-১৫০০ টাকার একটি শাড়িতে ফুল তুলতে ১৫০-২০০ টাকার সুতো লাগে। তার দাম মেলে ৪ হাজার টাকার মতো। নকশায় খরচ হয় ১৫০ টাকা। ৩০০-৪০০ টাকার একটি চাদরে সুতো লাগে ১০০ টাকার, ধোওয়ার খরচ ১০০ টাকা। মজুরি, বিপণন-সহ অন্য খরচ মিটিয়ে প্রতি শাড়িতে গড়ে ৩০০-৪০০, চাদরে ১৫০-২০০ টাকা মুনাফা থাকে মহাজনের ।

নানুর পঞ্চায়েত সমিতির সহ-সভাপতি মধুসূদন পাল বলেন, ‘‘ওই কুটিরশিল্পীদের জন্য প্রতি বছর প্রশাসনের পক্ষ থেকে মেলায় স্টলের ব্যবস্থা করা হয়। ভর্তুকিতে ঋণের ব্যবস্থাও রয়েছে। শিল্পীরা লিখিত ভাবে আবেদন করলে সাহায্য করা হবে।’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন