শৌচালয় নেই, পর্যটক টানতে জমিদান

ভরদুপুরে সপরিবারে ভাত ঘুম দিচ্ছিলেন বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ পরিবারের সদস্য সলিল সিংহ ঠাকুর। হঠাৎই তাঁর বাড়ির সদর দরজায় ঠক ঠক কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলতেই অচেনা এক তরুণী অনুরোধের সুরে বললেন, ‘‘অনুগ্রহ করে আপনার বাড়ির বাথরুম একটু ব্যবহার করতে দেবেন।

Advertisement

রাজদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়

বিষ্ণুপুর শেষ আপডেট: ২৬ অক্টোবর ২০১৬ ০০:২৩
Share:

বিষ্ণুপুরে শৌচালয় না থাকার সমস্যা এ বার কাটতে চলল। ট্যুরিস্ট লজের কাছেই এই শৌচালয় শীঘ্রই চালুর আশ্বাস দিয়েছে প্রশাসন।—নিজস্ব চিত্র।

ভরদুপুরে সপরিবারে ভাত ঘুম দিচ্ছিলেন বিষ্ণুপুরের মল্লরাজ পরিবারের সদস্য সলিল সিংহ ঠাকুর। হঠাৎই তাঁর বাড়ির সদর দরজায় ঠক ঠক কড়া নাড়ার শব্দ। দরজা খুলতেই অচেনা এক তরুণী অনুরোধের সুরে বললেন, ‘‘অনুগ্রহ করে আপনার বাড়ির বাথরুম একটু ব্যবহার করতে দেবেন। খুব বিপদে পড়েছি।’’ পাশেই দাঁড়িয়ে ছিলেন সলিলবাবুর স্ত্রী আলপনা সিংহ ঠাকুর। আগন্তুককে হাসি মুখে বাথরুমের দরজা দেখিয়ে দিলেন তিনি। এমনটা যে বছরে কতবার ঘটে, তার হিসেব নেই বলেই জানাচ্ছেন সলিলবাবু।

Advertisement

একই ঘটনার সাক্ষী হস্তশিল্প সামগ্রী শিল্পী জগন্নাথ আচার্যও। বিষ্ণুপুরের হাইস্কুল মোড় সংলগ্ন এলাকায় তাঁর দোকানেও বহু পর্যটক বাথরুম ব্যবহারের অনুরোধ নিয়ে হাজির হন। শুধু তাঁরাই নন। এই অনুরোধ নিয়ে হামেশাই পর্যটকদের বিষ্ণুপুরের দর্শনীয় মন্দিরগুলির আশপাশের বাসিন্দাদের দরজায় কড়া নাড়তে হয়। কেউ ফিরিয়ে দেন, কেউ মানবিকতার খাতিরে তাঁদের অনুরোধ মেনে নেন। তাই ঐতিহাসিক এই শহরে আসা পর্যটকদের মতোই স্থানীয় বাসিন্দারাও ন্যূনতম পরিকাঠামো না গড়ে তোলায় প্রশাসনের বিরুদ্ধে খড়গহস্ত।

এই ছবিটা এ বার কিছুটা হলেও বদলাতে চাইছে প্রশাসন। আর প্রশাসনকে সাহায্য করতে নিঃস্বার্থ ভাবে এগিয়ে এসে নজির গড়েছেন সলিলবাবু, জগন্নাথবাবুরা। সুলভ শৌচালয় গড়ার জন্য বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের অনুরোধে দু’জনেই জেলা প্রশাসনকে দান করেছেন এক কাঠা করে ব্যক্তিগত জমি। জমি পেয়ে শহরে তিনটি সুলভ শৌচালয় গড়তে উদ্যোগী হয়েছে প্রশাসন। যেখানে পুরুষ ও মহিলারা প্রাকৃতিক কাজ সারার পাশাপাশি স্নান করারও সুযোগ পাবেন। বিনিময়ে স্বল্প কিছু টাকা খরচ
করতে হবে।

Advertisement

সলিলবাবুর কথায়, “দেশ-বিদেশ থেকে কত পর্যটক বছরভর আমাদের শহরের অসামান্য শিল্পকৃতি দেখতে আসেন। কিন্তু রাস্তার পাশে শৌচালয় না থাকায় তাঁদের সমস্যায় পড়তে হয়। এ নিয়ে পুরবাসীদেরও লজ্জা ছিল। তাই মাসখানেক আগে বিধায়ক সুলভ শৌচাগারের জন্য জমি চাওয়ায় রাজি হয়ে যাই। পর্যটকদের সমস্যা মিটলেই আমরা খুশি হব।’’ স্বামীর এই উদ্যোগে সহমত তাঁর সহধর্মিনী আলপনা সিংহ ঠাকুরও। তিনি বলেন, ‘‘মহিলাদের সমস্যা দেখে কষ্ট হতো। শৌচালয় তৈরি হলে তাঁদের খুব সুবিধা হবে।’’ সলিলবাবু তাঁদের রাজদরবার এলাকায়
জমি দিয়েছেন।

জগন্নাথবাবু জমি দিয়েছেন লালগড় উদ্যান সংলগ্ন এলাকায়। দু’টি এলাকারই জমির দাম ভালই। কিন্তু তা সত্ত্বেও বিনামূল্যে তাঁরা কেন জমি দান করলেন? জগন্নাথবাবু বলেন, ‘‘শৌচালয় না থাকায় পর্যটকদের কষ্ট দেখে এতদিন নিজেরা মানসিক যন্ত্রণা পেয়েছি। আমার জমিতে শৌচালয় গড়ে উঠলে তাঁদের কষ্ট দূর হবে, আমার মানসিক যন্ত্রণাও কমবে। এটাই কি কম পাওয়া?’’

‘মল্লরাজধানী’ দেখতে বিষ্ণুপুরে আসা পর্যটকদের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গেই শহর ও তার আশপাশে লজ-হোটেলের সংখ্যাও বেড়েছে। পর্যটন-শিল্পের সঙ্গে যুক্ত অন্যান্য ব্যবসা-বাণিজ্যও ফুলে ফেঁপে উঠেছে। কিন্তু পর্যটকদের পরিষেবা দেওয়ার ক্ষেত্র নিয়ে ততটা উদ্যোগী হতে দেখা যায়নি প্রশাসনকে। জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকাও তেমনই ছিল বলে অভিযোগ। ফলে বাধ্য হয়ে দর্শনীয় স্থানগুলির আশপাশেই শৌচকর্ম করেন পর্যটকেরা। এর জেরে নাকে রুমাল চেপেও অনেক সময় ঘুরতে দেখা যায় লোকজনকে।

বছর দুয়েক আগে বিষ্ণুপুর পুরসভাকে একটি মোবাইল ‘টয়লেট ভ্যান’ নিজের তহবিল থেকে দিয়েছিলেন বিষ্ণুপুরের সাংসদ সৌমিত্র খাঁ। যদিও তাতে সমস্যা বিশেষ মেটেনি বলেই দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের।

ওই দুই ব্যক্তির দান করা জমি-সহ মোট তিনটি জায়গায় শৌচালয় তৈরি হচ্ছে। তার মধ্যে ট্যুরিস্ট লজের উল্টোদিকে বিষ্ণুপুর হাইস্কুলের মাঠে একটি সুলভ শৌচালয় তৈরির কাজ প্রায় শেষ করে এনেছে পূর্ত দফতর। প্রায় ২০ লক্ষ টাকা ব্যয়ের ওই শৌচালয়টি শীঘ্রই বিষ্ণুপুর মহকুমা প্রশাসনকে হস্তান্তর করা হবে বলে পূর্ত দফতর সূত্রে জানা গিয়েছে।

বাঁকুড়ার জেলাশাসক মৌমিতা গোদারা বসু জানান, সুলভ শৌচালয় গড়তে বিষ্ণুপুরের বাসিন্দারা যে জমি দিয়েছেন, সেখানেও শীঘ্রই কাজ শুরু হবে। একটির জন্য জেলা পরিষদের স্যানিটেশন দফতরের তরফে প্রায় ১৪ লক্ষ টাকা বরাদ্দ করা হয়েছে। অন্যটির জন্যও শীঘ্রই অর্থ বরাদ্দ করা হবে। বিষ্ণুপুরের বিধায়ক তুষারকান্তি ভট্টাচার্যের কথায়, “শহরে সুলভ শৌচালয় তৈরির জমির অভাব ছিল। জেলাশাসক জমির ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। শহরের মানুষও সমস্যার কথা জানতেন। তাঁরা জমি দেওয়ার আবেদনে সাড়া দেওয়ায়
আমি কৃতজ্ঞ।”

বিধায়ক জানাচ্ছেন, বিষ্ণুপুর মেলার আগেই দু’টি শৌচালয় তৈরি করে যাতে চালু করে দেওয়া যায়, সে জন্য জেলা প্রশাসনের সঙ্গে তিনি নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন। জেলাশাসকের আশ্বাস, তাঁরাও সেই চেষ্টা করছেন। ‘মল্লরাজধানী’ বিষ্ণুপুরের পরিকাঠামো গড়তে জেলা পরিষদ যাবতীয় সাহায্য করবে বলে আশ্বাস দিয়েছেন সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীও। তিনি বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষ্ণুপুরে পর্যটনের বিকাশে বিশেষ নজর রাখছেন। এই শহরের উন্নয়নের জন্য জেলা পরিষদ যথাসাধ্য সাহায্য করবে।”

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন