রোশনাই: সোনামুখীর চার মাথার মোড়ে কার্তিক ভাসানের শোভাযাত্রায় আতসবাজির প্রদর্শনী। মঙ্গলবার রাতে। নিজস্ব চিত্র
সন্ধ্যায় সপরিবার নিয়ে যাচ্ছি, বিকাশবাবু ব্যালকনিটা একটু ফাঁকা রাখবনে। অতসিদি পাড়ার মহিলারা কিন্তু আপনার বাড়ির ছাদ সন্ধ্যায় দখল নেবে। টুকটুকি তোদের ঝুল বারান্দাটা কিন্তু তাপসবাবুকে অনেক দিন আগেই আমার ডানকুনির বন্ধুদের জন্য বলে রেখেছি।
ক’দিন ধরে এমনই আবদারে নাস্তানাবুদ হচ্ছিলেন সোনামুখী চৌমাথার আশপাশের বাসিন্দাররা। কারণ আর কিছুই নয়, সোনামুখীর কার্তিক ভাসানের শোভাযাত্রা দেখা। আর দু’চোখ ভরে আতসবাজির প্রদর্শন চাক্ষুস করা। ফি বছরের মতো সোনামুখীর বাসিন্দাদের সঙ্গে আশপাশের এলাকার মানুষজন মঙ্গলবার রাত থেকে বুধবার দুপুর পর্যন্ত মেতে থাকলেন কার্তিক ঠাকুরের ভাসান শোভাযাত্রায়। কিন্তু গত কয়েক বছরের মতো দেখা যায়নি শব্দবাজির দাপাদাপি। দেখা যায়নি ডিজে-র ও শব্দ-তাণ্ডবও।
পুলিশের বারবার অনুরোধে জেলার অন্যত্র কালীপুজোয় শব্দ-তাণ্ডব রোখা গেলেও সোনামুখীতে কিন্তু হার মানতে হয়। পুলিশ কর্মীদের সামনেই রাতভর বেজেছিল শব্দবাজি। তারস্বরে বেজেছিল ডিজে। এ নিয়ে কম হইচই অবশ্য হয়নি। নতুন প্রজন্মের অনেকেই জানিয়েছিলেন, তাঁরাও এ সব পছন্দ করছেন না। তার পরে মাস ঘুরতে কার্তিকের ভাসানে ছবিটা বদলে গেল। তাতে স্বস্তি পেয়েছেন অনেকেই। তাঁদের দাবি, এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকুক।
সোনামুখী পুরসভা ও প্রশাসন জানাচ্ছে, কালীভাসানের ওই ঘটনা দেখেই তাঁরা ঠিক করেছিলেন, কার্তিক ভাসানে শব্দ-তাণ্ডবের পুনরাবৃত্তি আর হতে দেবেন না। তৎপর ছিল সোনামুখীর ১৭টি অনুমতিপ্রাপ্ত কার্তিক পুজোর সমন্বয় কমিটি এবং নতুন প্রজন্মের সোনামুখীর বাসিন্দারা। সোনামুখীর বাসিন্দা শ্রীকান্ত দে, বড় কার্তিক পুজো কমিটির দোলন দত্ত, মাইতো কার্তিক কমিটির অঙ্কিত ঘর, বকুলতলা কার্তিক পুজো কমিটির সোমনাথ দত্ত প্রত্যেকেরই বক্তব্য— ‘‘অনেক হয়েছে, আর নয়। আমাদের পুরনো ঐতিহ্যকে ফিরিয়ে আনতে হবে। শব্দবাজির দাপাদাপি নয়, আলোর রোশনাই আর তুবড়িতে আকাশ ভরিয়ে দিতে হবে। ডিজে-ও নয়, এ বার থেকে ঢাক-ঢোল, শিং বাজনা, তাসার আওয়াজেই আমরা আনন্দ করব।’’
পুজো কমিটিগুলি বুক কাঁপানো আসমান গোলা, কদম ঝাড়, বড় চকোলেট বোমা ইত্যাদি বাদ দেয়। জোর দিয়ে ছিল আলোর খেলায়।
‘‘কার্তিক পুজোর দিন থেকেই সোনামুখী শহরে ডিজে এবং শব্দবাজি কমে গিয়েছিল’’— বিসর্জনের শোভাযাত্রার তদারকির ফাঁকে বলছিলেন সোনামুখীর পুরপ্রধান তথা সমন্বয় কমিটির সভাপতি সুরজিৎ মুখোপাধ্যায়। তিনি জানান, পুজোর কয়েক দিন আগে থেকেই রীতিমতো মাইকে প্রচার করে, লিফলেট ছড়িয়ে এবং দফায় দফায় পুজো কমিটিগুলোর সঙ্গে বৈঠক করা হয়েছে। তার সুফল মেলায় তাঁরা স্বস্তি পেয়েছেন।।
বুক ধড়ফড়ানি করা শব্দবাজির বদলে সোনামুখীর আকাশে খেলল আলো। সেই দৃশ্য দেখতে চৌমাথার বাড়িগুলির ছাদ, বারান্দা, এমনকী কার্নিসে লোক থই থই করল। আশপাশের গ্রাম থেকে আসা লোকজনও ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে আতস বাজির রেষারেষি উপভোগ করলেন।
সোনামুখীর কলেজ পড়ুয়া তিথি দাস, বিদিশা ঘোষ, ঐন্দ্রীলা বন্দ্যোপাধ্যায়েরা বলেন, ‘‘সত্যি এ বার পুলিশ কর্মীদের সজাগ পাহারা কাউকে বেয়াদপি করতে দেয়নি। অনেক রাত অবধি সোনামুখী চৌমাথার আলোর প্রদর্শনী খুবই উপভোগ করেছি।’’
সোনামুখী থানার ওসি সামাদ আনসারি বলেন, ‘‘সবাই মিলে এগিয়ে আসার ফলেই এ বার ভাসান সবার কাছে আনন্দের হয়ে উঠেছে। সবাই মিলে চেষ্টা করলে যে সুফল পাওয়া যায়, তা সোনামুখী দেখিয়ে দিল।’’
বার বার এমনই রঙিন আলোর খেলা দেখতে চায় সোনামুখী।