পুরুষ সহকর্মীদের মধ্যে আলোচনাটা শুরু হয়ে গিয়েছিল ভোটের দিন ঘোষণা হওয়ার পর থেকেই। এ বার কার কার ডাক আসে! আর সঙ্গে প্রত্যেকের মনেই একটা চাপা দুশ্চিন্তা— ‘কী হবে বুথে গিয়ে’! আপনারা এত চিন্তা করছেন কেন? সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে বলা মাত্রই উল্টো দিক থেকে আক্ষেপ ঝরে পড়ল, ‘‘তোমাদের তো আর ভোট নিতে যেতে হয় না। তোমরা কী বুঝবে এর জ্বালা!’’
একটি উচ্চ মাধ্যমিক কো-এড স্কুলের শিক্ষিকা আমি। ভোটে আমাদের মানে মহিলাদের ডিউটি আসে না বলে আমরা সবাই যখন নিশ্চিন্ত, ভুলটা ভাঙল ঠিক তখনই। হঠাৎ করে সবাইকে অবাক করে দিয়ে চলে এল নির্বাচন কমিশনের ভোটের নিমন্ত্রণপত্র— ‘শুভমিতা সাহা, প্রিসাইডিং অফিসার’।
বাড়ির সকলকে একরাশ চিন্তার মধ্যে ফেলে বন্ধু ও সহকর্মীদের ভোট সংক্রান্ত নানা টিপস মাথায় ভরে একটা অন্যরকম উত্তেজনা নিয়ে ভোটের আগের দিন সকালে হাজির হলাম সিউড়ি ডিসিতে। সেখানে পৌঁছে দেখি ভোটকর্মীদের বিশাল সমাগম। সবাই বেশ কৌতূহলী। একপ্রকার বিস্ময় চেপে রাখতে না পেরে এক জন তো বলেই ফেললেন, ‘‘এঁরাও (মহিলা) এ বার ভোটের ডিউটি করবেন!’’ সমস্ত মালপত্র বুঝে পোলিং অফিসারদের সঙ্গে আমাদের বুথ সাঁইথিয়া পুরসভা অফিসে যখন পৌঁছালাম, ঘড়িতে বিকেল ৫টা। সেখানে দেখি প্রচুর গোলাপি বেলুন, ফুল দিয়ে সাজানো আর কেন্দ্রীয় বাহিনী দিয়ে ঘেরা আমাদের ‘মহিলা বুথ’। বুথে পা দেওয়া মাত্রই মনে হল নিজেই যেন নিজেকে বলে উঠলাম, ‘ইওর টাইম স্টার্টস নাও’!
জীবনের প্রথম ভোটের ডিউটি করতে আসা, ফলে প্রচণ্ড উত্তেজনা আর নানা টেনশনে প্রায় সারারাত না-ঘুম অবস্থায় কাটল। শুধু মনে হচ্ছিল, বিরাট দায়িত্ব, ঠিকঠাক সামলাতে পারব তো! আরও দু’টি মহিলা বুথ ওখানে হয়েছিল। দেখি বাকি দুই মহিলা প্রিসাইডিং অফিসারেরও আমারই মতো অবস্থা। ভোটের দিন সকাল ৬টার মধ্যেই আমরা তৈরি। ৬টায় পোলিং এজেন্টদের সঙ্গে নিয়ে ‘মক পোল’ শুরু করতে হবে। কিন্ত সওয়া ৬টাতেও কোনও এজেন্টের দেখা নেই। দুশ্চিন্তাতে কী করব ভাবছি, তখনই দেখি এক জন হন্তদন্ত হয়ে ঢুকছেন হাতে এজেন্টের নিয়োগপত্র নিয়ে। সেক্টর অফিসারের নির্দেশ মতো সেই এজেন্টের উপস্থিতিতে যে-শুরু হল মক পোল। আর ঠিক তখনই অন্য একটি রাজনৈতিক দলের এজেন্ট হাজির। এসেই চেঁচামেচি শুরু করে দিলেন— ‘‘এ কী! আপনারা ভোট শুরু করে দিলেন? এটা কি ছাপ্পাভোট চলছে?’’ শুনে তো আমার হাত-পা ঠান্ডা হওয়ার জোগাড়। সর্বনাশ! ঝামেলা কি প্রথম থেকেই শুরু হয়ে গেল! বহু কষ্টে ওই এজেন্টকে বোঝালাম ভোট শুরু হবে ৭টায়। এখন ইভিএম ঠিক আছে কিনা দেখার মহড়া ভোট চলছে। অবশেষে তিনি বুঝলেন। আমিও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম!
কেন্দ্রীয় বাহিনী ভোটার কার্ড বা যথাযথ পরিচয়পত্র ছাড়া কাউকে বুথ চত্বরে আসতে দিচ্ছিলেন না। তাই আশাতীত ভাবে খুব নিরুপদ্রবে ঠিক ৪টেই ভোট শেষ হল। দেখা গেলো মোট ৮৬৫ জন ভোটারের মধ্যে ৭৫৪ জন ভোট দিয়েছেন। মনে হল যেন একটা বড় পরীক্ষা দিয়ে শেষ করলাম! অথচ দিনের শুরুটাই হয়েছিল মক পোল নিয়ে দুই বিরোধী এজেন্টের ঝামেলা। কিন্তু, তার পরে ভোটের গোটা দিনজুড়ে বিরোধী দুই এজেন্টের মধ্যে যে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান দেখতে পেলাম, তাতে আমি বিস্মিত এবং মুগ্ধও!
এ যেন উলটপুরাণ!
ভোট শেষে বাসে করে ফিরলাম সিউড়ি আরসি-তে। সব কিছু জমা দেওয়ার পরে সেখান থেকে বেরিয়ে দেখি কোনও বাস নেই। আমরা কয়েক জন মহিলা প্রায় ২ কিলোমিটার হেঁটে এক জায়গায় এসে বাড়ি ফেরার বাসে চাপলাম। তখন রাত ১০টা বেজে গিয়েছে। শ্রান্ত শরীর-মন নিয়ে বাসে আসতে আসতে মনে হল, যতটা আশঙ্কা করেছিলাম ততটা নয়— ভালমন্দ, সুবিধা-অসুবিধা মিলিয়ে অন্য রকম অভিজ্ঞতা হল। প্রিসাইডিং অফিসার হয়ে জেলার প্রথম মহিলা বুথগুলির একটির দায়িত্ব সামলানোর এই অভিজ্ঞতা— জীবনের খাতায় একটি বিশেষ পর্ব হিসাবে লেখা থাকবে।
(লেখক নলহাটির বুজুং বিএনএ শিক্ষাপীঠের সহকারী শিক্ষিকা)