ইন্দিরা আবাসে ‘দুর্নীতি’

ভুলির ঘরে দু’বার টাকা, আঁধারেই রয়েছেন বুলি

একই ব্যক্তি। ঠিকানাও একই। আলাদা কেবল বিপিএল কার্ডের নম্বর। সেই তাঁর নামেই দু’-দু’বার ইন্দিরা আবাস যোজনায় ঘর বরাদ্দ হয়েছে। আর সেই ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকল্পের টাকাও তোলা হয়ে গিয়েছে দু’বারই।

Advertisement

অপূর্ব চট্টোপাধ্যায়

রামপুরহাট শেষ আপডেট: ০৩ জুলাই ২০১৬ ০১:২৯
Share:

ভগ্ন চালায় বুলি মাল। নিজস্ব চিত্র।

একই ব্যক্তি। ঠিকানাও একই। আলাদা কেবল বিপিএল কার্ডের নম্বর। সেই তাঁর নামেই দু’-দু’বার ইন্দিরা আবাস যোজনায় ঘর বরাদ্দ হয়েছে। আর সেই ব্যক্তির অ্যাকাউন্ট থেকে প্রকল্পের টাকাও তোলা হয়ে গিয়েছে দু’বারই।

Advertisement

কোনও অভিযোগ নয়, সরকারের নথি থেকে মিলছে এমন তথ্য। রামপুরহাটের কুতুবপুর গ্রামের এই ঘটনায় বিষয়টি নজরে এনেছেন গ্রামেরই এক বাসিন্দা। দ্বিতীয় বার তাঁরই বিপিএল কার্ডের নম্বর ব্যবহার করে টাকা প্রকল্পের তোলা হয়েছে বলে অভিযোগ। ঘটনার খবর জানাজানি হতেই শোরগোল পড়ে যায় এলাকায়। বিরোধীদের দাবি, ইন্দিরা আবাস যোজনায় দুর্নীতির এটি একমাত্র উদাহরণ নয়। কুতুবপুরের ওই দৃষ্টান্ত আদতে একটি বড় আর্থিক দুর্নীতির প্রতিই ইঙ্গিত করছে। বুলি মাল নামে ওই মহিলার কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে ইতিমধ্যেই পূর্ণাঙ্গ তদন্তের নির্দেশও দিয়েছে প্রশাসন।

প্রশাসন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, ২০১২-’১৩ আর্থিক বর্ষে দখলবাটি পঞ্চায়েতের কুতুবপুরের ভুলি মালের নামে ওই প্রকল্পে গৃহ নির্মাণের টাকা বরাদ্দ হয়। বর্তমানে সেই টাকায় তৈরি বাড়িতেই তিনি বসবাস করছেন। ২০১৫-’১৬ আর্থিক বর্ষের গৃহ নির্মাণ প্রকল্পে প্রাপকদের তালিকাতেও সেই ভুলির নাম উঠেছে। প্রথম বার তাঁর বিপিএল কার্ডের নম্বর দেওয়া হয়েছিল— ‘ডব্লুবি ০৩-০০৭-০০৪-০০৬/৩৩৭৬৭’। দ্বিতীয় বার— ‘ডব্লুবি ০৩-০০৭-০০৪-০০৬/৩৩৮১৯’। এ ব্যাপারে ভুলিকে জিজ্ঞাসা করা হলে একই প্রকল্প থেকে দু’বার টাকা মেলার কথা তিনি স্বীকার করে নেন। তাঁর কাছে থাকা ব্যাঙ্কের টাকা তোলার রসিদ দেখিয়ে ভুলি জানান, ২০১৫ সালের ১১ মে থেকে ২০১৬ সালের ৩১ মে পর্যন্ত প্রকল্পে মোট ৬৯ হাজার ৫০০ টাকা তোলা হয়েছে। এমন ঘটনা কী করে ঘটল? ভুলির দাবি, ‘‘সংসদের তৃণমূল পঞ্চায়েত সদস্য মহম্মদ সাদেক আমার কাছ থেকে ভোটার কার্ড ও পাসপোর্ট সাইজ ফোটো চেয়েছিলেন। পরে তিনি আমাকে জানান, ইন্দিরা আবাস যোজনায় আরও কিছু টাকা বরাদ্দ হয়েছে। সেই মতো আমি ওই টাকা ব্যাঙ্ক থেকে তুলেছি। তার জন্য সাদকককে ২৫ এবং পঞ্চায়েতের কর্মীকে ৫ হাজার টাকা ভাগ দিতে হয়েছে।’’ বাকি টাকাটা অবশ্য তিনি নিজের কাজে ব্যবহার করেছেন বলে মেনে নিয়েছেন।

Advertisement

ভুলি দু’-দু’বার টাকা পেলেন। কিন্তু, কপাল ফেরেনি গ্রামেরই বৃদ্ধা বুলি মালের। তাঁর ক্ষোভ, ‘‘আমারই বিপিএল কার্ডের নম্বরে প্রকল্পের টাকা বরাদ্দ হল। অথচ ঘর তো পেলামই না, টাকাগুলোও অন্যদের ঘরে ঢুকল!’’ ওই ঘটনায় দুর্নীতির অভিযোগ জানিয়ে তাঁর প্রতি হওয়া অবিচারের প্রতিকার চেয়ে গত ১৭ জুন চিঠি দিয়ে জেলাশাসক, মহকুমাশাসক এবং বিডিও-র দ্বারস্থ হন। তার পরেই নড়েচড়ে বসে প্রশাসন। বিডিও-কে তদন্তের নির্দেশ দেন এসডিও (রামপুরহাট) সুপ্রিয় দাস। তার পরেই সংশ্লিষ্ট কর্মী-আধিকারিকদের কাছ থেকে ওই ঘটনায় উল্লিখিত দুই আর্থিক বর্ষের যাবতীয় নথি চেয়ে পাঠিয়েছে প্রশাসন। তবে, তদন্ত বর্তমানে কোন পর্যায়ে, তা নিয়ে মন্তব্য করতে চাননি রামপুরহাট ১ বিডিও নীতিশ বালা।

নিয়ম অনুযায়ী, ইন্দিরা আবাস যোজনার উপভোক্তাদের নামের তালিকা অনুযায়ী তাঁদের কাঁচা বা পাকা ঘর আছে কিনা প্রথমে তা তদন্ত করা হয়। পঞ্চায়েতের কর্মীরা সেই তদন্তের পরে রিপোর্ট দিলে পঞ্চায়েতের নির্বাহী সহায়ক এবং প্রধান তাতে সই করে ব্লকে বরাদ্দ অনুমোদনের জন্য পাঠিয়ে দেন। সে ক্ষেত্রে প্রশ্ন উঠছে, একই ব্যক্তি দু’টি পৃথক বিপিএল নম্বর ব্যবহার করে দু’বার কী করে টাকা পেয়ে গেলেন? পঞ্চায়েতের সিপিএম প্রধান সাফিক হোসেনের বক্তব্য, ‘‘সব কিছু খতিয়ে দেখে উপভোক্তার তালিকায় পঞ্চায়েতের রিসোর্স পার্সন এবং নির্বাহী সহায়ক সই করেন। তাঁদের সই দেখে নিয়ম মতো আমিও তাতে স্বাক্ষর করেছি।’’ তাই ওই ঘটনা কী করে ঘটল, তা তাঁদেরই পক্ষে বলা সম্ভব বলে সাফিকের দাবি। যদিও ওই ঘটনায় তিনি কোনও ভাবেই জড়িত নন বলে দাবি করেছেন নন্দদুলাল মাল। তাঁর দাবি, ‘‘কোথাও একটা ভুল হয়েছে। এলাকার মানুষ জানেন, কাজের জন্য আমি কারও কাছ থেকে এক পয়সা খাই না।’’ একই সুরে ঘটনার সঙ্গে তিনি জড়িত নন বলে দাবি করে বুলিদেবীর বিরুদ্ধেই মিথ্যা অপবাদ দেওয়ার পাল্টা অভিযোগ তুলেছেন তিনি।

যদিও দায় কোনও ব্যক্তির নাকি প্রশাসনের, সে উত্তর জানেন না বুলিদেবী। মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার আশায় এসডিও অফিস থেকে পঞ্চায়েত, ঘুরে ঘুরে হয়রান হচ্ছেন তিনি। তাঁর প্রশ্ন, ‘‘বর্ষা চলে এলো। তারপোলিনের ছাউনি দেওয়া ভগ্নপ্রায় ঘরে কোনও রকমে থাকি। আমার কথা কি কেউ ভাববে না?’’

(সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, X (Twitter), Facebook, Youtube, Threads এবং Instagram পেজ)

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
Advertisement
Advertisement
আরও পড়ুন