খড়ের চালার এক চিলতে ঘরে দাদা রাবন বাউরির সঙ্গে সস্ত্রীক বসবাস করেন ভাই লক্ষ্মণ বাউরি। ফি বছর বর্ষায় চালার ফাঁক দিয়ে ঘরে জল পড়ে। ঝড়ে উড়ে যায় খড়ের চালা। রাবন, লক্ষ্মণদের অভিযোগ, পঞ্চায়েতের লোকজন কাগজে কলমে তাঁদের বাড়ির অবস্থা ভালো বলে উল্লেখ করে দেওয়ায় প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার প্রাপকের তালিকায় নাম থাকা সত্বেও তাঁরা ঘর পাননি।
পেশায় গাড়ি চালক আব্দুল সামিদ বায়েন খড় ও ত্রিপলের ছাউনির ঘরে স্ত্রী ও চার ছেলে মেয়েকে নিয়ে থাকেন। প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার প্রাপক তালিকায় তাঁর নাম উঠেছে কি না জানতে গিয়ে ছিলেন ব্লক দফতরে। গিয়ে জানতে পারেন, রিপোর্টে পঞ্চায়েতের পরিদর্শক তাঁকে মৃত বলে উল্লেখ করে দিয়েছেন। শুনে হতবাক হয়ে যান সামিদ।
রাবন, সামিদরা ইঁদপুরের গৌরবাজার গ্রামপঞ্চায়েতের বাসিন্দা। কেবল তাঁরাই নন, গৌরবাজার গ্রামপঞ্চায়েতের ঘরপাথর, আজাদপল্লির মতো বিভিন্ন গ্রামের বহু মানুষ যোগ্য হয়েও প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্প থেকে বঞ্চিত হয়েছেন বলে বিডিও-র কাছে অভিযোগ জানিয়েছেন। ঘটনার তদন্ত করে বিডিও গোপাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রতিক্রিয়া, “সব না হলেও কিছু অভিযোগ সত্যি। যাঁরা যোগ্য হয়েও প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনায় ঘর পাননি তাঁদের এর পরের ধাপে অন্তর্ভুক্ত করা হবে।”
ঘটনা হল, ২০১৬-১৭ অর্থবর্ষে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্পে বাৎসরিক লক্ষমাত্রার ১০০ শতাংশ ঘর অনুমোদন করে রাজ্যে নজির গড়েছে বাঁকুড়া জেলা। তবে এই প্রকল্প ঘিরে রাজনীতির অভিযোগও উঠছে জেলা জুড়ে। প্রশাসনিক সূত্রে জানা গিয়েছে, প্রকল্পের জন্য ২০১১ সালের সামাজিক ও অর্থনীতির ভিত্তিতে জনগণনার রিপোর্ট অনুযায়ী জেলায় ২ লক্ষ ৩৩ হাজার পরিবারের জন্য বাড়ি বরাদ্দ করা হয়েছিল।
কিন্তু ওই জনগণনার পরে দীর্ঘ সময় কেটে গিয়েছে। তাই পরিবারগুলির আর্থ-সামাজির অবস্থার হেরফের হয়েছে কি না তা জেনে প্রাপক তালিকা সংশোধন করা জরুরি হয়ে পড়ে। বিভিন্ন গ্রামপঞ্চায়েতে গ্রামসভা করে প্রায় ৭০ হাজার পরিবারকে প্রকল্প থেকে বাদ দেওয়া হয়।
সেই সময় থেকেই রাজনৈতিক কারণে বহু যোগ্য পরিবারকে প্রাপক তালিকা থেকে বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে অভিযোগ উঠতে শুরু করে। বিভিন্ন ব্লক মিলিয়ে জেলা জুড়ে প্রায় পাঁচ হাজার অভিযোগ জমা পড়ে। সেই সব অভিযোগ খতিয়ে দেখতে জেলা প্রশাসন তিন সদস্যের একটি কমিটি বানায়। প্রায় দু’হাজার অভিযোগের সত্যতা খুঁজে পায় প্রশাসন। তালিকা সংশোধন করে সেই পরিবারগুলিকে প্রাপক তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়। প্রশাসন সূত্রে জানা গিয়েছে, এখনও পর্যন্ত ১ লক্ষ ৬৫ হাজার মানুষ প্রকল্পের প্রাপক তালিকায় ঠাঁই পেয়েছেন। কিন্তু তাতেও অভিযোগ ওঠা বন্ধ হয়নি।
এই ঘটনার জন্য বিরোধীরা রাজ্যের শাসক দলকে দুষছে। শাসক দলের নেতারা ২০১১ সালে জনগণনার দায়িত্বে থাকা লোকজনের দিকে আঙুল তুলছেন। বিজেপি-র রাজ্য নেতা সুভাষ সরকার বলেন, “কেন্দ্রীয় প্রকল্পের সুবিধা সাধারণ মানুষকে না দিয়ে কেবল শাসক দলের নেতারাই লুঠ করছেন।” বাঁকুড়া জেলা পরিষদের বিরোধী দলনেতা সুব্রত মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা প্রকল্প আদপে গ্রামপঞ্চায়েত প্রধান প্রকল্প হয়ে দাঁড়িয়েছে।” এই পরিস্থিতিতে প্রশাসনের আধিকারিকদের আরও সক্রিয় হওয়ার দাবি তুলেছেন তিনি।
বাঁকুড়া জেলা পরিষদের সভাধিপতি অরূপ চক্রবর্তীর পাল্টা বক্তব্য, “কন্যাশ্রী, দু’টাকা কেজি চাল, পানীয় জল কি বিজেপি বা সিপিএম কর্মীরা পাচ্ছেন না? উন্নয়নের কাজে আমরা ভেদাভেদ করি না।” তাঁর দাবি, জনগণনার তালিকা যাঁরা বানিয়েছিলেন তাঁরাই গোলমাল করেছেন। তাই বহু যোগ্য মানুষ প্রকল্প থেকে বাদ পড়েছেন।
অতিরিক্ত জেলাশাসক (জেলা পরিষদ) নবকুমার বর্মন বলেন, “যাঁরা যোগ্য হওয়া সত্বেও প্রথম ধাপে প্রকল্প থেকে বাদ পড়েছেন তাঁদের কী ভাবে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে তা নিয়ে কেন্দ্রে ভাবনা চিন্তা শুরু হয়েছে। নির্দেশিকা আসলেই অন্তর্ভুক্ত করার কাজ শুরু হয়ে যাবে।”